ভ্যাঁ দিবস


[একটি সাধু-চলিত মিশ্রিত ব্যর্থ রম্য প্রয়াস]

গুণীজনেরা কহেন, “ভালবাসা ভাল নহে, ইহা দেহ এবং মন উভয়ের জন্য পীড়াদায়ক।” মনের জন্যে পীড়াদায়ক বুঝিলাম, কিন্তু দেহের জন্য কিভাবে? যেই বালক মনের আকুলবিকুল ভালবাসা প্রকাশ করিতে গিয়া স্বীয় কপোলে পঞ্চ অঙ্গুলীর ছাপ নিয়া ফিরিয়াছে ইহা কেবলমাত্র সেই বুঝিবে এবং মর্মে মর্মে অনুধাবন করিবে। তাহার পরেও মনুষ্য প্রজাতি ভালবাসিয়া যায় এবং বাসিতে বাসিতে অর্থ-সম্পদ সমস্তকিছু হাস্যমুখে বিসর্জন দেয়। এক্ষেত্রে পুরুষের যায় অর্থ আর নারীর যায় সম্পদ। উভয়েই সব হারাইয়া আবার নতুন করিয়া বাঁচিয়া উঠে। কিন্তু নিতান্তই আফসোসের বিষয়, এই নতুন জীবনে দেহ-মন সবকিছুই তাহারা পায় শুধু আর ‘মজা’ পায় না।



ভ্যাঁ দিবসে কতিপয় মানুষ একত্রিত হইয়া ভ্যাঁ ভ্যাঁ করিবে, ইহা আর নতুন কি? মূর্খ স্কুলবালক রিকশাভাড়া বাঁচাইয়া হলমার্কসের কার্ড কিনিয়া পার্শ্ববর্তী গার্লস স্কুলের সুন্দরী ছাত্রীকে উপহার দিবে। বালিকা তাহা গাম্ভীর্যের সাথে গ্রহণ করিবে এবং বাসায় ফিরিয়া কয়খানা কার্ড পাইল তাহা গণণা করিতে করিতে হাসিয়া কুটিপাটি হইবে। বৈকালে তাহার ভার্সিটি পড়ুয়া হোম টিউটর আসিয়া বলিবে, “আজকে একটা বিশেষ দিন? তুমি কি তাহা জানো?” চতুর বালিকা কৌতুকময় হাসি হাসিয়া বলিবে, “আজকে আমি ক্লাসটেস্টে হাইয়েস্ট পেয়েছি। এইজন্যে ইহা আমার কাছে একটা বিশেষ দিন।”

কলেজ বালক-বালিকা বয়সের দোষে কিংবা গুণে এইসব ব্যাপারে খানিকটা অগ্রসর। তাহারা এই দিনে সময় সুযোগ মিলিয়ে ভাসানী থুক্কু বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের আলো আধারীতে কিসমিস খেলে। বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে পপকর্ণ খাইতে খাইতে হারাইয়া যায়, ডিজে ক্লাবে গিয়া ‘চাম্মাক চালো’ নৃত্য করে। তাহাদের অনেকেই এইদিন প্রথমবারের মতন অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়া আরো একটুস পরিপক্কতা লাভ করে। মতিঝিল এলাকার কলেজের মেধাবী ছেলেগুলো এইদিন সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় জ্যাম লাগাইয়া দেয়। ব্যাচে ব্যাচে যাহারা জ্ঞানার্জন করে তাহারা ঐদিন রসায়ন, পদার্থ আর বলবিদ্যা বাদ দিয়া প্রেমার্জন করিতে সর্বস্ব ঢালিয়া দেয়।

ভার্সিটি পড়ুয়ারা ঢের অভিজ্ঞ। কতিপয় হ্যান্ডসাম যুবক এবং ড্যাশিং সুন্দরীদের জন্য ইহা ঈদ বিশেষ। ঈদে যেইরূপ নতুন জামা কাপড় নেয়া হয়, ভ্যাঁ দিবসে তাহারা সেইরূপ নতুন গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড চুজ করিয়া লয়। তাহার পরে আর কি? সবাই মিলিয়া ইয়ো ইয়ো করে। ভ্যাবলাকান্তরা নিত্যদিনের মতন বসিয়া বসিয়া কবিতা লেখে আর বুড়োর গান রিভিশন দেয়। আগুনে পুড়িয়া পুড়িয়া অনেকে নজরুল হইয়া ওঠে। টিএসসিতে তাহারা আন্দোলন করিতে চায়, কিছুক্ষণ লোক হাসানো কাজ কারবার করিয়া ক্লান্ত হইয়া বইমেলায় গিয়া চা পান করে। ইস্মার্ট যুবকের দল কনসার্টে ঝাঁকানাকা করিয়া রূমে গিয়া পানি খাইয়া আবোল তাবোল বকে আর যাহারে তাহারে জড়াইয়া ধরে, নাউযুবিল্লাহ।

আরেক দল আছে, কামলা বা শ্রমিক বিশেষ। তাহাদের মধ্যে যাহারা তখনো প্রেমে মশগুল, ভ্যাঁ দিবস আসিলে তাহারা ভ্যাঁ করিয়া কাঁদিয়া দেয়। কিভাবে বসের নিকট হইতে অর্ধদিবস ছুটি মিলিবে, খাদ্য-বস্ত্র-দৈনন্দিন খরচ বাঁচাইয়া গিফট খরিদ করিবে, টুনিকে আরকটাদিন সবুর করিতে বলিবে ইত্যকার টেনশনে তাহাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এই শ্রেণীর অনেকে ভাবে, ঢের হইয়াছে, আর নহে। তাহারা আর লাইসেন্স বিহীন সম্পর্কে আগ্রহ দেখায় না, যেকোন মূল্যে একখানা ড্রাইভিং লাইসেন্স আয়ত্ব করিতে চায়। আগের জন্মে যাহারা অধিক মাত্রায় ইয়ো ইয়ো করিয়াছিল তাহারা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া কহে, লাইফ সাক্স।

বিবাহিতের দল ভ্যাঁ দিবস আসিলে ফিক করিয়া হাসিয়া দেয়। অতীতকালের মূর্খামির কথা ভাবিয়া আর চতুর্পাশ্বের পরিবেশ অবলোকন করিয়া মনে মনে বলে, রে মূর্খের দল, কবে তোরা মানুষ হইবি? বাসায় ফিরিয়া যখন আয়েশ করিয়া মধু মিশ্রিত গলায় শুধায়, “সোনাবউ আজ কি রাঁধিয়াছ?” উত্তর আসে, ঝাঁটার বাড়ি। নির্লজ্জ পুরুষ খ্যাক করিয়া হাসিয়া ক্যাটরিনাতে মনোনিবেশ করে। মৎস্য একবার ধরিবার পরে ছিপ ফেলিয়া বসিয়া থাকা নিরর্থক। রমনীরা মিষ্টি মধুর স্মৃতি জাবর কাটিতে কা্টিতে ভাবে, আমাদের যেই দিন গিয়াছে, তাহা কি চিরতরেই গিয়াছে?

সর্বশেষ যে হতভাগার দল, কোনকালেই যাহারা ভ্যাঁ দিবসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করিতে পারে নাই, আগুনে পুড়িয়া কয়লাও হইতে পারে নাই তাহারা কি করে? কেউ ঈর্ষান্বিত, ক্রোধান্বিত হইয়া হম্বিতম্বি করে, “রূপসী মেয়েগুলোর মস্তিষ্কে যদি তিল পরিমাণ ম্যাটারিয়ালস থাকিত তাহলেও তাহারা আশেপাশে চক্ষু ঘুরাইয়া অমূল্য মানিক রতন খুঁজে পাইত। কিন্তু জগতের নির্মম পরিহাস তাহাদের চক্ষু নাই।” বেকুব যুবকের দল বুঝিতে পারে না, পরিশ্রম বিনা সিকি মিলে না যেইখানে, সেইখানে অমৃত কিভাবে মিলিবে! স্বীয় প্রজাতিতে আকৃষ্ট হইতেও অনেকে পিছপা হয় না, তাহারা ভাবে, দিন বদলাইছে না, আমাদিগের ও স্বীকৃতি মিলিবে। আর চিরকালীন আশাবাদীরা নিজেদের প্রবোধ দেয় - সামনের বার, সামনের বার এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করিব, এক্কেবারে হতচ্ছাড়াদের দেখাইয়া দিব, হুমম।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন