ফ্লাইওভার, রেললাইন কিংবা চিকেন গ্রিল

জোছনা ধোঁয়া এক ভর সন্ধ্যা বেলায় হাঁটতে বের হলাম। আমার বাড়ীর কাছেই রেললাইন। লাইন ধরে হাঁটা। তেমন অসুবিধা হয় না। চারদিকে আলোয় ভুবন ভরা। আমি অপেক্ষা করছি। প্রথম ট্রেনটা কোনদিক দিয়ে আসবে। আমার পিছন দিক দিয়ে না সামনের দিক দিয়ে। আমার ধারনা, পিছন দিক দিয়ে আসবে। শত্রুগুলো কখনো সামনে দিয়ে আসেনা। ওরা অতর্কিত আসে, সাহস ওদের এত বেশী না যে সামনে দিয়ে আসবে। যেই কথা সেই কাজ। ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। আমার পিছনে আলোর ঝলকানি আস্তে আস্তে বাড়ে। শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কেমন যেন নেশা নেশা লাগে। আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি। পৃথিবীটা মায়াময় লাগে। রূপালী চাঁদ উপর থেকে মুচকি আসে। কিন্তু ওটাকে দেখে আচমকা ক্ষুধা মাথা চারা দিয়ে উঠল। নান রুটি আর চিকেন গ্রিল হাত উঠিয়ে ডাকতে থাকে। সোজা রেললাইন ছেড়ে চেনা হোটেলের পথ ধরি। আগে পেট ঠান্ডা তারপর আবজাব।



গ্রিল খাবার সময় বেশ শান্তি শান্তি লাগে, বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই। রাতে অবশ্য নির্ঘাত পেটে বিষম বেদনা হয়। তারপরেও আরেকটু সস কিংবা আরো একটা নানরুটির জন্য থালা বাড়িয়ে দেই। খাওয়া শেষে বের হতে হতে ফুটপাতের ভিক্ষুক কয়েকজনকে চোখে পরে। মাঝে মধ্যে আমার দিলে যখন অনেক দয়া হয় অথবা ঘুরিয়ে বলা যায় মানিব্যাগে দুটাকার ময়লা নোট থাকে তখন বের করে দেই। বেশীরভাগ সময় দেই না, কি দরকার খামাখা! আমি এইমাত্র শখানেক টাকা ঢেলে নাস্তা সারলাম, আর এই বেচারা দুটাকা দিয়ে কেমনে রাতের খাবার জোঁটাবে।

সোডিয়াম আলোমাখা শহরে বেশ লাগে ঘুরতে। ফ্লাইওভারের উপরটা আরো সুন্দর, পুরা মায়াবী। এই দিকটায় গাড়ীর চাপ নেই, আমি উঠি ফ্লাইওভারে। অ-নেকদিন পর উঠলাম। শেষবার উঠেছিলাম দুই দোস্তের সাথে। স্কুলফ্রেন্ড, কলেজফ্রেন্ড, এলাকার ফ্রেন্ড সব বলা যায় এদের। কিন্তু এখন যোগাযোগ নাই। ফোনাফুনির অভ্যাস আমার কোনকালে ছিল না। আর ওদের ফোন করার নিশ্চয় অনেক পাবলিক আছে। কে কারে মনে রাখে এই সময়ে!

একটু পর পর সাঁই করে একটা দুটো গাড়ী চলে যায়। আমি ওদের মুখোমুখি নিরাপদ দূরত্বে হাঁটি। এককালে আমার গাড়ী কেনার বেশ শখ ছিল। আমার একটা গাড়ী থাকবে, সেই গাড়ীতে এসি হাওয়ায় ধুম ধারাক্কা গান শুনতে শুনতে উড়াল দেব আকাশে। আমার সাথে কোন দেবী থাকতে পারে। তার যদি ইচ্ছা হয় তবে তার সাথে বিশেষ কিছু পূজা অর্চনাও চলতে পারে। এক্সিডেন্টের ভয় এড়াতে বেশীদূর আগানো যাবে না। আমরা গাড়ী থামাবো আশুলিয়ার প্রান্তরে। নিঝুম নিরবতায় যদি কিছু হয় দোষ হবে জোছনার!

এইসব রোমান্টিকতা এখন আর টানে না। যে জ্যাম রাস্তাঘাটে গাড়ী কিনে দেখা যাবে, রিকশা সাইড দিয়ে এগিয়ে যায়, সাইকেলকে সাইড দিতে হয়। গাড়ী কিনতে একবার হয়ত পারা যাবে। তারপর দেখা যাবে তারে পুষতে আমাকে গ্রিল ছাড়তে হচ্ছে। এর থেকে এই ভাল আছি। সেই দিন বেশী দূরে নাই, যেদিন এই জাতি হাঁটতে শিখে যাবে, যানবাহন চিরতরে বিলুপ্ত হবে। মিরপুর থেকে সকালবেলা মর্নিং ওয়াক করতে করতে লোকজন মতিঝিলের অফিস পৌঁছে যাবে। তারপর গোসল করে কোপায়া কাজ করবে। খুশী হয়ে বস দিবেন বোনাস বাড়িয়ে। উন্নয়নে উন্নয়নে দেশ সয়লাব।

ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই রেললাইন। সব পথ এক জায়গায় এসে শেষ হয়। আমি পথিক না। আমাকে ঘরে ফিরতে হবে। আজকে ভাবে পেয়েছে। ঘরে ফিরে একটা কবিতা লিখে ফেললাম, সাই-ফাই কবিতা। সেই কবিতাখানা দিয়ে লেখার ইতি টানি। তুমি ভাল থেকো।

এলোমেলো দিন... স্বপ্নবিহীন...
খোঁজে অকাতরে
এতটুকু ঠাঁই, একটুকু ঠাঁই ...
নীল সে জোছনা, চোখে লেগে থাকে
ভালবাসা গুলো শূন্যে মিলায়…
আর কিছু বোবা কাশফুল
আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসে
মাছরাঙ্গার দল ডেকে যায়
ডেকে যায় …

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন