এক টুকরো গোধূলি


আধশোয়া হয়ে আমি আকাশ দেখি। সেখানে মেঘে মেঘে অনেক বেলা। বিকেল হলেও মনে হচ্ছে প্রায় সন্ধ্যা। আমার ঘুম পায়। অন্যদিন হলে দেখা যায় ঘুম আসে না, আজ ঠিক করেছি বাইরে যাবো। আলসেমি আমাকে ছাড়ে না। আমার দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে আরো ভাল করে আকাশ দেখি। নাহ, বৃষ্টি হবে না।

ঝিলপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে রিকশা খুঁজি। এখানে অনেক মানুষ। বেশীরভাগ আন্টি পিচ্চিকাচ্চা সমেত। কোন তরুণী নিদেনপক্ষে কিশোরী দেখতে পাই না। তারা অনেক ব্যস্ত। বালকের দল আজকাল ক্রিকেট বাদ দিয়ে ফুটবল ধরেছে। এটা আশার কথা না হতাশার জানি না। আমাদের এখানে অভিজাত লেক প্লাস পার্ক নেই। একটা ময়লাফেলা আটকেপড়া পানির ঝিলকে লেক বানিয়ে, পাশের একটুখানি চওড়া রাস্তাকে পার্ক বানিয়ে এলাকাবাসী বিকেলবেলার মেলা বসিয়েছে।

রিকশায় যেতে যেতে হারানো দিনের কথা মনে পড়ে। আমার টিউশনিকাল সম্ভবত শেষ হয়েছে। এমন ঝিমিয়ে পড়া বিকেলে আমি থাকতাম শিক্ষক বেশে, টেবিলের ওপাশে কোন কৌতুহলী অথবা নির্বিকার শিক্ষার্থী। বলবিদ্যার অংকগুলো কিংবা ইন্টিগ্রেশনের সূত্রগুলো কি ভুলেই গেলাম! ভুলে গেলে তেমন চিন্তার কিছু নাই। নোটখাতা গুলো এখনো ফেলে দেইনি। ওগুলোকে খুব মায়া লাগে।


শান্তিনগরের টুইন টাওয়ারের সামনে ব্যাপক ভীড়। মানুষের কী খেয়ে দেয়ে কাজ নাই নাকি? সারাবছর ধরে শপিং করে! আজকে অবশ্য শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্বামীকে পথ ভুলিয়ে বউয়েরা আসতেই পারে, আমি আসবো দেখে তারা নিশ্চয় ঘরে বসে থাকবে না। আমি নিজে কিছু কিনতে বের হলাম মনে হয় ছয় মাস পর। চাকরীর শুরুতে অনেক কিনতে হয়েছিল। ফর্মাল ড্রেস আমার বলতে গেলে কিছুই ছিল না। প্রথমদিন অফিস করার পরে ম্যাডাম সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন, টি-শার্ট আর জিন্স পরা যাবে না। আজকে কেনাকাটার তেমন দরকার ছিল না। তবু বের হবার পিছনে আমার লোডশেডিং থিংকিং এর হালকা অবদান আছে।

একদিন রাতে কম্পুর সামনে বসে ছিলাম। বরাবরের মতন কারেন্ট চলে গেল। এ আর নতুন কী! চেয়ার ছেড়ে বিছানায় কাত হই। নষ্ট চার্জারের টিমটিমে আলোয় কোনকাজ করা যায় না। পেপার পড়া, গল্পের বই পড়া, লেখালেখি কিচ্ছু না। ওহ, একটা কাজ করা যায়। চোখ বন্ধ করে বা খুলে ভাবনা-চিন্তা করা যায়। দেশ-দুনিয়া, আমি-তুমি, অতীত-ভবিষ্যৎ, ইহকাল-পরকাল সব নিয়ে ভাবা যায়। প্রতিরাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আমি ভাবতে বসি। কয়েকটা এপ্লিকেশন বানানোর আইডিয়া আসে, দুয়েকটা সিরিজ লিখতে মন চায়। বাস্তবায়ন করার ধার ধারি না। আমি ভাবতে থাকি। এই ভাবনার নাম দিয়েছি “লোডশেডিং থিংকিং”।

ঐ রাতে ভাবতেছিলাম। হঠাৎ মনে হল, আমার সময় কাটে না, একঘেয়ে জীবন আর ভাল লাগে না – এর একটা বিহিত করা দরকার। ভাল লাগবে না কেন? ভাল লাগাইতে হবে। কি করা যায়! প্রতিদিন ভোরে উঠে গোসল-নাস্তা-দৌড়। অফিসে বসে কাজ থাকলে কাজ। না থাকলে ফেইসবুকিং-ব্লগিং-ফেইসবুকিং-ব্লগিং। কত আর পারা যায়! আট/নয় ঘন্টা পর ছুটি হলে বাসায় ফিরে সেই একই বৃত্তে আটকে পড়া। লাইফে কোনো বৈচিত্র্য নাই। বৈচিত্র্য আনতে হবে। অফিসের পাঁচদিন না হয় বাদ দিলাম। সন্ধ্যার পরে এনার্জি তেমন থাকে না। ঐ সময় মুভি দেখে, বই পড়ে কাটায় দিতে হবে। কিন্তু আল্লায় দিলে আমার এখন অনেক অবসর। ছুটির দুইদিন ঝিমাইতে ঝিমাইতে ক্লান্ত হয়ে যাই।

আমি সোশ্যাল না। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ঈদ, দাওয়াত ছাড়া পারতপক্ষে যাই না। আড্ডাগুলোতে সতর্কভাবে দূরত্ব বজায় রাখি। স্বাভাবিকভাবে বন্ধুর সংখ্যা হাতেগোনা। আট/দশ জন যাদেরকে বন্ধু বলে মানি, তারা বেজায় ব্যস্ত। অনেকের সাথে ছুটির দিনে মেলেনা। কেউবা জিআরই করে, কেউ ফ্রিল্যান্সিং, কারো জবে অনেক প্রেশার। আমার সাথে কেউ নাই। এক কলিগ কাম ফ্রেন্ডকে বললাম, “চল শুক্রবারে দূরে কোথাও বেড়ায় আসি।” সে বলে, “আমার খেয়েদেয়ে অনেক কাজ আছে। ছুটির দিনে আমি বাজার করি।”

আমি ভাবতে থাকি আর সমাধান খুঁজি। কি করা যায়? যেই কাজটা ভাল পারি সেটা প্রথম মাথায় আসে। টিউশনি করা যায়। খুচরা পয়সা আসলো, সাথে সুন্দর মতন টাইম পাস। এখন টিউশনি কই পাই! দুয়েকটা জুনিয়রেরে বলতেই চোখ মুখ শক্ত করে এমন ভাব করে যে কথা অন্যদিকে নিয়া যাই। থাক, পোলাপানের সুখের দিনে বাগড়া না বাজানো ভাল।

ফ্রিল্যান্সিং করা যায়। এর আগে একটা ল্যাপটপ কিনতে হবে। এক ঘন্টা পরপর বিদ্যুত বিভ্রাটে ডেস্কটপ দিয়ে অন্তত কোডিং করা যায় না। এখন হাতে পয়সাকড়ি জমে নাই। সুতরাং এই চিন্তা আরো কিছুদিন পরে এপ্লাই করা যেতে পারে।

থিংকিং করতে করতে মাথা ধরে যায়। একদিকে ভ্যাপসা গরম আরেকদিকে মশার কামড়। ধুরো ছুটির দিনে আমি ঘুরাঘুরি করবো। যেদিক খুশী সেদিক। একলা একলাই ঘুরবো। যা থাকে কপালে। বাসে করে কোন এক জায়গায় গিয়ে নামবো। তারপর হাঁটতে থাকবো। সাথে থাকবে বাদাম আর বিগ সাইজের চকোলেট। এক শুভাকাঙ্খী আমার ক্রমাগত ওজন হ্রাস ঠেকাতে এই চকোলেট পরামর্শ দিয়েছেন। মাঝে মধ্যে মুভি দেখবো সিনেমাহলে। সেই নটরডেম লাইফের মধুমিতা, বুয়েট লাইফের বলাকা আর এই জমানার সিনেপ্লেক্স। তিনটাতে যাবো। সঙ্গী না পেলে একাই না হয় দেখলাম, কী আছে জীবনে!

সমাধান পেয়ে বেশ উত্তেজিত লাগে। কবে আসবে নেক্সট উইকেন্ড। ভ্রমন প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখি আমার সেই দিন আর নাই। ড্রয়ার ভর্তি সব ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট। অনেক খুঁজে যেসব বুয়েট গেঞ্জি – টিউশনি জিন্স পাই, বড় মলিন। এইজন্যে আজকে এই গোঁধূলিবেলায় কেনাকাটা করতে বের হওয়া। টুকটাক শপিং শেষে বেইলিরোডের মোড়ে নিজেকে আবিষ্কার করি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে উদ্ভাসিত জোছনা।

এবার খাওয়া-দাওয়ার পালা। কেএফসি-বিএফসি, বুমারস-আলবাইক, বাতাসে ফ্রায়েড চিকেনের মৌ মৌ গন্ধ পাই। ভার্সিটি ছাড়ার পরে এসব জায়গায় পারতপক্ষে আসি না। একা খুব আনইজি লাগে। নিজের কাছে খালি মনে হয়, আশপাশের সবাই ভাবছে, এই যুবক একলা কেন? ঐদিন রাতে সিদ্ধান্তে আসলাম, ডোন্ট কেয়ার করতে হবে। কয়েকদিন আনইজি লাগবে, পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। ফেইসবুকে এক বড়ভাই একটা কমেন্ট করেছিল, “পেট ভরে খাও,তারপর সামান্য আরো একটু খাও। এরপরও মৃদু খাও। এরপর দেখবা খারাপ লাগা মাথা থেকে পেটে এসে হাজির হবে। খাওয়া দাওয়া করলে বেশির ভাগ সময় ইনস্ট্যান্ট মন ভালো হয়ে যায় বা খারাপ লাগাটা ঠিক হয়ে যায়।” কথাটা খুব মনে ধরেছে। আজকে এটার এপ্লাই করে দেখি।

বিএফসিতে ঢুকি। পুরা সরগরম। ফাঁকা জায়গা নাই বললে চলে। পরী আর রাজকন্যাদের সাথে বিচ্ছিরি সব ছেলেপেলে। আমার রাগ লাগে। জুটি সেইম সেইম না হলে মারাত্মক মেজাজ খারাপ হয়। কিউতে আমার ঠিক পিছনে এক সুন্দরী। তার সাথে কাউকে দেখি না। এমন কি হতে পারে, তার বয়ফ্রেন্ড বসে আছে। আর সে আসছে অর্ডার দিতে। আজকাল হয়ত মেয়েরা শুধু ট্রিট নেয় না, ট্রিট দেয়ও। আমি অর্ডার দেয়ার পরে কানপেতে শুনি, আমাদের দুজনের অর্ডার সেইম। উনিও আমার মতন অর্ডার দিয়েছেন ১ পেপসি। তার মানে কি সে একলা?!

দুজনের একটা টেবিলে বসে তার দিকে নজর রাখি। সে গিয়ে বসে আরেকপ্রান্তে দুজনের আরেক টেবিলে। এক যোগ এক দুটো সিট নষ্ট হলো। খানিকক্ষন পরে আরো অনেক মানুষ আসে। জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা দুজন ভারসাম্য রক্ষা করতে এগিয়ে আসি না। খাবার আসলে আমি আস্তে আস্তে ভুলে যাই –একাকী সুন্দরীর কথা, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন বিবাহিত জুটির কথা, মোবাইলের দিকে মাথা নিচু করে অপেক্ষায় থাকা মিষ্টি মেয়েটির কথা। সব ভুলে যাই।

রিকশায় উঠে খুব ফ্রেশ লাগে। বড় বড় এপার্টমেন্টের সাথে লুকোচুরি খেলা মস্তবড় চাঁদ আর রাতের তারাদের দেখে মনে ভাব জাগে। একটু জোরেই গান ধরি। চারটা লাইন মাত্র পারি।

আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন