জোছনা ধোঁয়া দিনরাত্রি

বাড়ির পিছনে সবাই মিলে ডাব খাওয়ার জটলা আমি দারুন উপভোগ করি। মামুন ভাই গাছে চড়তে বেশ দক্ষ। এমনিতে ডাব পেড়ে আনার লোক থাকলেও সে এই কাজটা নিজের শখে করে। আমরা সবাই তৃষ্ণার্ত নয়নে অপেক্ষায়। একটা একটা করে ডাব পড়ে আর “এইটা আমার” “এইটা আমার” বলে ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি। ছোট ফুপ্পি আসে ডাব কেটে দিতে। সুমিষ্ট পানীয় আর সেটার থেকে বেশী আকর্ষণীয় ডাবের শাস খাওয়ার ধুম লেগে যায়।




বেলা বাড়লে ছোট চাচা জাল কাঁধে বড় পুকুরের দিকে হাঁটা শুরু করেন। আমরা ছেলের দল, পিচ্চিরা সবাই তার পিছু পিছু। জাল নিয়ে খেলা দেখাতে ছোট চাচার সাথে সাথে যায়েদ ও বিশেষ দক্ষ। মামুন ভাই এই কাজে পারদর্শী না, কিন্তু যায়েদের কাছ থেকে তার শেখার বিশেষ আগ্রহ। বড় বড় মাছ ধরা দেখা অনেক মজার ব্যাপার। আমি মনোযোগ দিয়ে সেটা উপভোগ করি। এই পুকুর সেই পুকুরে জাল ফেলে যখন মন ভরার মতন মাছ জোটে তখন আমরা বাড়ীর পথ ধরি। বড় সাইজের তাজা চিংড়ীগুলোকে দেখে আমার প্রেম প্রেম লাগে।


বাড়ী ফিরে দেখা যায় মেয়েদের দল লবন-মরিচের আসর বসিয়েছে। কাঁচা-পাকা বরই, ডাসা পেয়ারা, জলপাই আর কামরাঙ্গার আসরে ঝাপিয়ে পড়তে আমার কখনোই আপত্তি ছিল না। টক-ঝাল খেতে খেতে চোখে পানি চলে আসার পরে আমরা ক্ষান্ত দেই আর চলে দুপুরের ভুড়ি ভোজের প্রস্তুতি। আমরা বেড়াতে আসলে দাদী রসুই ঘরে না এসে পারেন না। তার নেতৃত্বে চাচীরা আর ফুফুরা মিলে চলতে থাকে রন্ধনশৈলী। অপূর্ব সুবাসে ক্ষিধে মাথায় উঠার ঠিক আগে সবাই পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে গোসল সারি।


রুটি-পিঠা আমার সবথেকে প্রিয় খাবার। বড় ফুপির বানানো রুটিগুলো এত মোলায়েম হয় যেন মাখন, আর দাদীর হাতের হাঁসের ঝোল এক কথায় অপূর্ব। পাল্লা দেয়ার ব্যাপারটা আমাদের সব ভাইয়ের মাথায় থাকে। কিন্তু খাওয়ার উত্তেজনায় কেউ কখনো হিসেব ঠিক রাখতে পারিনা। অমীমাংসিতভাবে শেষ হয় আহার পর্ব তৃপ্তির ঢেকুর তুলে।


তারপর সেই কাঠের সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গড়াগড়ি। ঘুম চলে আসার আগে আগে আমরা চলে যাই বাড়ীর উঠোনে। শুরু হয় ক্যারাম আর ব্যাডমিন্টন উৎসব। জোড়ায় জোড়ায় লড়াই চলে সেইরকম। বাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে সূর্যিমামার আলো আস্তে করে কমে আসে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে আর একটু পরে উথাল পাথাল জোছনা।


এমন অপার্থিব সাঁঝবেলায়, আমরা জমাট বেঁধে বসি শান-বাঁধানো পুকুর ঘাটে। জল-জোছনার খেলা দেখি আর ভেসে যাই সুরের মেলায়। সামী গান ধরে কিশোর কুমার আর যায়েদ কুমার শানু। গানের কলি শুরু হয়। একে একে আমাদের সাথে যোগ দেয় নচিকেতা, অঞ্জন, এন্ড্রু কিশোর, আইয়ুব বাচ্চু এবং আরো সবাই।

সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রং ছিল ফাল্গূনী হাওয়াতে
সব ভাল লাগছিল চন্দ্রিমা
খুব কাছে তোমাকে পাওয়াতে


রাত বাড়ে। ভুত-প্রেত নেমে আসার আগে আমরা জোছনা ধোঁয়া উঠোনকে একা রেখে বাড়ীতে ঢুকে যাই। আমাদের দোতলা দাদাবাড়ীর উপরতলা তখন পুরো সরগরম। জোড়ায় জোড়ায় লুডু কিংবা সাপ-লুডু চলছে এখানে সেখানে। গায়ে লেপ জড়িয়ে চান্স পেলে খেলে ফেলি দু’এক দান। সাপের দংশনে ক্ষত-বিক্ষত একেক জন হরেক রকমের মাছভাজা দিয়ে রাতের আহার সারি।


এত বড় বাড়ীটায় আমরা সবাই আসলে পুরো ভরে যায়। শীতের রাতে লেপ নিয়ে কাড়াকাড়ি। যায়েদ শুরু করে সত্যি ভুতের ভয়ংকর সব কাহিনী। সেগুলো শুনে সবার খুব ঘুম পেয়ে যায়। কে কখন ঘুমিয়ে যাই কেউ জানে না।


স্বপ্নে স্বপ্নে এখনো মাঝে মাঝে আমি সেই সব দিনরাত্রির খুব কাছে পৌঁছে যাই। জানি দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। আমরা সবাই একসাথে একত্রিত হতে পারব না। তারপরেও আসছে শীতে বাড়ী যাব, ভাবতেই মন অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠছে। বাড়ী যাব আমার বাড়ী।

[৭-১২-২০১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন