একটি জবা গাছ আর আমরা ক'জনা

বাড়ির পিছনের আধেক ক্ষয়ে যাওয়া পুকুর ঘাটে একলা বসে আছি। সেই শান-বাধাঁনো পুকুর ঘাট আজ আর নেই। পুকুরের পানিও সেই আগের মত টলটলা নেই, কেমন যেন একটা সবুজাভ আস্তরন। চারপাশটা বড় বেশী শান্ত আর নিঝুম – অদ্ভুত রকমের মন খারাপ করা। অসহ্য এই নিরবতা দূর করতে একটা একটা করে বরই জলের মাঝে ছুড়ে মারতে থাকি, হাত দুটো খালি হলে মনটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগে।




এই পুকুরের ধারেই একটা জবাফুলের গাছ ছিল। গাছ না বলে ওটাকে আমাদের বাড়িও বলা যেতে পারে। জবাগাছ আকারে বেশী বড় না হলেও এটা বেশ বড় ছিল, আর সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হল এর একেকটা শাখা আমাদের মত একেকজন ছোট ছোট মানুষকে অনায়াসে ধারন করতে পারত। আজ সেই গাছটি নেই আর তার বাসিন্দারাও শেষ কবে একসাথে হয়েছে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। দাদুর মুখে যখন প্রথম শুনি গাছটা কেটে ফেলা হয়েছে তখন মনে হয়েছিল আমার ঘর যেন কেউ ভেঙ্গে দিয়েছে।

সবচেয়ে উঁচু শাখায় বসত সামী। আমার বছর তিনেকের বড় হলেও বাবার মৃত্যু তাকে অনেক বদলে দিয়েছে। এখন সে বিরাট এক পীর। রুবা ও বেশ উঁচুতেই থাকত, কলেজের ইংরেজি টীচার হতে যার খুব বেশী দেরী নেই। সাহজাদী আর যায়েদ দু ভাইবোন থাকতো মাঝের শাখা গুলোয়। সাহজাদী এখন ইটালীতে থাকে স্বামীর সাথে, দুটা ফুলের মতন বাচ্চা হয়েছে ওর। বছর দুয়েকের বড় হলেও ওকে “তুমি” করে ডাকতাম, বিয়ের পর “আপনি” তো বটেই রীতিমত আপু ডাকা শুরু করি – দুলাভাইয়ের সুনজরে থাকতে হবে না !!! চেষ্টা বৃথা যায়নি, আমার প্রথম গিফট পাওয়া মোবাইলখানা দুলাভাইয়ের দেয়া। যায়েদ টাও অনেক দূরে সরে গেছে। আমি ফোন দিলে ধরেনা, কারন জানে সবসময় আমি তাকে রাজনীতির ছাইপাশ ছেড়ে চলে আসতে বলব।

ক্লাস ওয়ান আর টুতে পড়া মেরী আর আমি ঝুলতাম নিচের ডালগুলোয়। ছোট হওয়ায় উপরে চান্স পেতাম কম। আর আমাদের রুম ও নির্ধারিত ছিল, কাজেই আগে উঠলেও অন্যের ডালে বসতাম না। মেরী আমার আট মাসের ছোট। তারপরেও গত বছর যখন ওর বিয়ে হয় আমি মনে মনে তাকে আপু ডাকার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। কিন্তু আমাকে পুরো অবাক করে দিয়ে সে বড় গলায় আমাকে “ভাইয়া” ডাকা শুরু করে দেয়  !!! আমার এই বোনটাও আজ বহুদূরে স্বামীর সাথে মিশরে আছে।

জবা গাছ নেই, তার মানুষগুলো ও নেই। আমি একলা একলা পুকুর পাড়ে হাটি বিষন্ন মনে, নিজেও দাদাবাড়ি এসেছি পাঁচ বছর পর। একটু পর পুচ্চি জেনারেশন আমাকে ঘিরে ধরে আর তাদের দলনেতা নাইনে পড়ুয়া বোনটা আমার হাতে জলপাই ভর্তা তুলে দেয়। আমি কেমন যেন ওদের সাথে সহজ হতে পারিনা, নিজেকে বেমানান লাগে। আমার খেলার সাথীরা সব কই ??

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন