এইটা তোমার গল্প

ভোরবেলা যখন মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে এত কষ্ট লাগে। উফ আবার সকাল! তারপর সেই রোজকার বেঁচে থাকা। গোসল নাস্তা সারতে সারতে ঘড়ির কাঁটা আটটা ছাড়ায়। তুমি দৌড়ে নামো সিড়ি দিয়ে। গলি পেড়িয়ে মোড়ে দুইটা রিকশা দেখা যায়। আয়েশ করে মামারা বসে আছেন।

মামা যাবেন? কই যাইবেন? মালিবাগ মোড়। না ঐদিক যামু না।
কোন দিক যাবেন। একটু নামায় দিয়া আসেন না মামা। বিশ টাকা দেই।
পাঁচ টাকা বেশী দেয়ার পরেও অনেক অনিচ্ছাসত্তে রিকশাওয়ালা রিকশা টানতে শুরু করে। সকাল বেলার হাল্কা বাতাস তোমার গায়ে লাগে। তুমি ভাবতে থাকো আজকের দিনটা কেমন যাবে। কি কি মেইল জমা হয়েছে আজ ইনবক্সে। মালিবাগ পৌছার ঠিক আগ দিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

মামা পাটি আছে? উনি মাথা নাড়েন। ভিজতেই ভিজতেই কোনমতে রিকশা থেকে গন্তব্যে নেমে একটা দোকানের সামনে আশ্রয় খোঁজো তুমি। সেখানে নানান রকমের মানুষ। জোড়েসোরে বৃষ্টি শুরু হয় এবার। তোমার ভাল লাগে না, একদমই না। কখন এই অযাচিত বৃষ্টি থামবে আর অফিস পৌছাঁবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা। এমন সময় রিকশা থেকে নেমে সাদা ড্রেস পরা এক মেয়ে ছুটে এসে তোমার পাশে দাঁড়ায়। খানিকক্ষনের জন্য সব ভুলে যাও। একসাথে নিশ্চুপ বৃষ্টি দেখতে হঠাত মন্দ লাগে না। একটু একটু করে বৃষ্টির বেগ কমে আসে, আশেপাশের লোকজনের তাড়া অনেক বেশী। তারা এর মাঝেই ভিজতে ভিজতে নেমে যায় কাজে। পাশের মেয়েটি একসময় একবারের জন্য ও তোমার দিকে না ফিরে রাস্তা পেড়িয়ে চলে যায় অজানার দিকে। তারপর বৃষ্টি আরো কমলে বাস কাউন্টারে গিয়ে তুমি পরবর্তী যুদ্ধে নেমে পড়ো।

এই পার্টটা সবথেকে বিরক্তিকর। ৬ নম্বর বাসের গেটে এক্টুখানি ঝুলার জায়গা পাবার জন্য মানুষজনের প্রানান্তকর লড়াই। সেখানে বৃথা সময় নষ্ট না করে অন্যদিকে চেষ্টা করা। কিন্তু বলাকার হেল্পার মামারা সিটিং সিটিং বলে প্রচন্ড ভাব দেখিয়ে তোমার সামনে দিয়ে চলে যাবে। শত অনুরোধ করেও তাদের মন গলাতে পারবে না। পুলিশ মামাদের আবার বেশ আরাম। তারা যেকোন বাসে ফ্রিতে চড়ে বসতে পারে। হতাশ ব্যর্থ হয়ে একমাত্র কাউন্টার বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকো। বেশ অনেকক্ষন পর বাস আসে। ভাগ্য ভাল হলে অবশেষে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু মেলে।

বাসের সিটে যেসব ভাগ্যবান লোকজন বসে আছেন তাদের অনেকের হাতে দেখা যায় “বাংলাদেশ প্রতিদিন”। কেউ কেউ বলে এর কাটতি নাকি প্রথম আলোকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনটাকায় সব টাটকা খবর। কারো কারো হাতে “আমাদের সময়”, কেউ আবার পড়ে “অপরাধ কন্ঠ”। কি বাহারী নাম পত্রিকার, অপরাধ তার আবার কন্ঠ! আজব ব্যাপার হলো বাংলাদেশ প্রতিদিনে হরতালের খবর সবার আগে আসে। আর স্ক্যান্ডাল আর আজেবাজে মুখরোচক খবর এগুলোতেই বেশী আসে। দুই/তিন টাকায় মানুষজন বাসের সময়টুকু ভুলে থাকে। তুমি হ্যান্ডেলে বাদুড় ঝোলা ঝুলতে থাকো। বৃষ্টি থেমে রোদ উঠে গেছে শহরে। জ্যামের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। মালিবাগ-মগবাজার পার হওয়া, সে অনেক খানি পথ। এই সময়ে তুমি অন্যকিছু ভাবতে পারো।

ভার্সিটি লাইফের কথা মনে পড়ে। এখন ক্লাসে থাকার কথা। বোর্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত লিখে ভরে ফেলেছেন স্যার। সেই সাথে চলছে দুর্বোদ্ধ লেকচার। মাঝের দিকের জানালার পাশের বেঞ্চে বসে তুমি আকাশ দেখো আর বিশাল গাছটা। তোমার ঠিক উল্টোপাশের বেঞ্চে কর্নারে বসেছে দীঘল কালো চুলখোলা মেয়েটি। সে মন দিয়ে লেকচার তুলতে থাকে আর তুমি মন দিয়ে তাকে দেখো। বাসের ঝাকুনিতে অথবা পাশে দাঁড়ানো লোকের গুঁতোতে তোমার ধ্যান ভাংগে। আবার পৃথিবীতে ফিরে এসে দেখতে পাও রোজকার গিয়ানজাম। সেই মহিলা সিট ক্যাচাল, সিটিং ভাড়া অথবা ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে ক্যাচাল ইত্যাদি ইত্যাদি।

মহাখালী ফ্লাইওভার গিয়ে একটা সিট মিলে যায়। আয়েশ করে বসার পর বড় বড় বিলবোর্ডে চোখ যায়। সেখানে সারিকা/শখ কে দেখতে মন্দ লাগে না। রঙ্গীন রঙ্গীন স্বপ্ন কল্পনা তোমার মনে যে আসে সেটা মিথ্যা না। প্রভাবীয় গন্ডগোলে একটু স্তিমিত হয়ে গেছে আরকি। গন্তব্য এসে পড়ে। তুমি বাম পা আগে বাড়িয়ে কাকলীতে নেমে পড়ো, ছুটতে থাকো কর্মযুদ্ধে।

চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার আগে সিরিজ অফ মেইল চোখে পড়ে। সেইসব এক পাশে সরিয়ে ফেসবুকে লগিন, কোন নোটিফিকেশন আছে কি? বেশী না, চারটা নোটিফিকেশন। রাতে যে স্ট্যাটাস দিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলে সেখানে লাইক পড়েছে তিনটা আর কমেন্ট মোটে একটা। ন্যাকামি কমেন্ট তোমার ভাল লাগে না, তারপরেও কি আর করা! সৌজন্যবোধের কারনে উত্তর দিতে হয়। আজাইরা একটা গ্রুপে কেউ এড করেছে, ত্যক্ত হয়ে রিমোভ করতে হয়। আজ ও কোন আকাংখিত মেসেজ আসেনি, বরং অচেনা কেউ পোক করে যাচ্ছে নিরন্তর। হেডফোন কানে লাগিয়ে তুমি হোম পেইজে মনোযোগ দাও। সেখানে দেশ ও দশ উদ্ধার করে ফেলেছে লোকজন। পাঁচমিশালী লিংক ক্লিক ফ্লিক করে অবশেষে তুমি শুরু কর কর্মজজ্ঞ। কিছুক্ষণ চাকুরী করা যাক!

কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলিগদের বাহারী রিংটোন বেজে ওঠে। কারো বউ ফোন করে, কারো শ্যালিকা কিংবা গার্লফ্রেন্ড। তুমি নিরীহ মানুষ, সচরাচর ফোন টোন আসে না। কালেভদ্রে যা আসে তা অচেনা নাম্বার থেকে ইন্টারভিউয়ের কল! কোন সুরেলা কন্ঠ হয়ত বলে ওঠে, অমুক দিন অমুক সময় আপনার একটা ভাইভা আছে। আপনি কি আসতে পারবেন? তুমি কোনরকমে হ্যা হু করে ফোন রেখে দাও, পাছে বর্তমান জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা অন্তত টিকে থাকে।
সময় চলে যায়। সূর্যাস্তের আরো ঘন্টা দুয়েক পরে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে মেলে মুক্তি। ঘরে ফেরা যাক! আবার সেই যুদ্ধ। তুমি যোদ্ধা, বিজয় আসবেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন