নীরার জন্য ভালোবাসা ...

নগরীর ধুলোমাখা রাস্তায় একা একা হাঁটছে হাসান। রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে তার মন্দ লাগে না, অন্তত বাসায় বসে ঝিমানোর থেকে ব্যাপারটা অনেক ভাল, সঙ্গী থাকে না সবসময়। তার অনেক বন্ধু - স্রেফ বন্ধু। এই অদ্ভুত বিষণ্ণ শহরে তার জন্য কোন প্রেমিকা অপেক্ষা করে থাকে না, তবে সে অপেক্ষা করে থাকে একজনের জন্য!


বহুদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো
হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে। নীরা, আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো। আমি অন্য কথা
বলার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে-মনে
ঘর ভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে নিজস্ব চোখে তাকাবো।
তুমি জানতে পারবে না — তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে
আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা।

সুনীল – প্রিয় কবি... প্রিয় লেখক... কিংবা প্রিয় আশ্রয়! হাসান বড় হয়েছে সুনীল পড়ে, হাসান নিজেকে চিনতে শিখেছে সুনীলের কাছে, এরপর হাসান প্রেমিক হয়েছে নীরার জন্য!


সেই নীরা! তার সাথে দেখা ভার্সিটির শুরুর দিন গুলোতে। এরপর কেটে গেছে সাত বছর! এখনো নীরা আশেপাশে থাকলে প্রতিদিন নতুন লাগে, প্রতিটা ক্ষণ শিরার মধ্যে একটা আনন্দ অনুভব করতে পারে। হাসান সবার ভাল বন্ধু হতে পারে, হ্যাঁ – সে নীরার ও খুব ভাল একজন বন্ধু বটে। বন্ধুত্ব আছে, থাকবে, যতদিন নীরা আছে, যতদিন হাসানের অস্তিত্ব আছে। তারপরেও তো কথা থাকে। হাসান নীরার জন্য এমন কিছু অনুভব করে যা পৃথিবীর আর কারো জন্য করে না, করা সম্ভব হয় না।

- তুই সেই নীরা
  তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
- সে আর এমন কি শক্ত? এক্ষুনি তা দিতে পারি
- তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
- কী আছে আমার? জানি না তো
- তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
- সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
  তখন তো বলোনি কিছু?
  আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
  আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
- দেবে কি দুঃখের অংশভাগ? আমি
  ধনী হবো
- আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও
  কোনো সুমহান আবিষ্টতা
  আমাকে রয়েছে ঘিরে
  তার কোনো ভাগ হয় না
  আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে?
- তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই!



নয়টা-পাঁচটার অফিস হাসানের ভাল লাগে না, বদ্ধ দেয়ালের গম্ভীরতা ভাল লাগে না। হয়ত মুক্ত আকাশে ঘুড়ি উড়াতে ভাল লাগে, হয়ত শান্ত নদীর সাম্পানে ভেসে বেড়াতে ভাল লাগে অথবা চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে হারিয়ে যেতে। আসলে আমি জানি না হাসানের সত্যি সত্যি কী ভাল লাগে। সুনীল জানে, আর একজন খুব সম্ভব জানে – নীরা।

নীরা এখন কোথায় আছে? কেমন আছে?

কর্পোরেট নিরেট কাঠিন্যে সে হারিয়ে যায়নি, মনে হয় হারিয়ে যাবার অভিনয় করছে। এখনো সে রক্ত-মাংসের মানুষ, স্নেহময়ী বোন, হাস্যোজ্জ্বল বন্ধু, বুদ্ধিমতি নারী! মুক্ত প্রজাপতির মত ঘুরে বেরানোর অবসর তার হয় না, সে বড় ব্যস্ত মানুষ – অফিস, ক্লাস আরো শত ব্যস্ততা। এত কিছুর পরেও একটা শূণ্যতা থাকে, থাকতেই পারে – প্রকৃতির নিয়ম!



চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ
ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে
যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম
প্রবাসের চিঠি
অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো
আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা
ও যে বহুদূর,
পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর
ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে
খুঁজে পাবো?

সেদিন প্রবারণা পূর্ণিমা ছিল, আকাশে উড়ছিল লক্ষ লক্ষ ফানুস। দূর প্রবাসে হোটেলের বারান্দায় বসে নীরা আকাশ দেখছিল, তার মন বিষণ্ণ, ভাবছিল দেশের আপনজনের কথা। কাজের ফেরে পরে এই উৎসবের সময়ে তাকে স্বজন বিহীন কাটাতে হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সে জানতে পারে খুব কাছের এক বন্ধুর বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গিয়েছে -  সে এখন হাসপাতালে আছে। ডাক্তাররা বলেছে, অপারেশন লাগবে, বাম পায়ের একটা আংগুল কেটে ফেলে দিতে হতে পারে।

নীরার প্রচন্ড খারাপ লাগে হাসানের কথা ভেবে, ছেলেদের মধ্যে হাসান তার সবথেকে কাছের বন্ধু। নীরার খুব ইচ্ছে করে হাসানের বাইকে করে অনেক দূরে কোথাও ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু কোন এক অজানা কারণে সেই কথা সে হাসানকে কখনো বলেনা। সেই বাইকেই এক্সিডেন্ট হল, আর মনে হয় চুল উড়িয়ে দেয়া হবে না উদ্দাম হাওয়ায়। না হলে হবে না, কিছু আসে যায় না। এখন একটাই প্রার্থনা – হাসান সুস্থ হয়ে উঠুক, তার অপারেশন সফল হোক, আংগুল যাতে বেঁচে যায় আল্লাহ...



বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল
স্বপ্নে বহুক্ষণ
দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–
বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে
তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের
নীল দুঃসময়ে।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাসান নীরার কথা ভাবে, স্বপ্নের মধ্যে ঘুরে-ফিরে সে আসে। বাস্তবের নীরা হাজার মাইল দূরে। নীরার যেদিন ফ্লাইট, হাসানের ইচ্ছে ছিল তাকে বিদায় দেয়ার। তারপর মনে হল – থাক কী দরকার! আত্মীয়-স্বজনের ভীড়ে অনাহুত মানুষে বিরক্ত হবে, এর থেকে হাসান এইটুক প্রত্যাশা করে, ফিরে আসুক নীরা এই শহরে, এই যাওয়া যেন হয় নতুন করে ফিরে আসার জন্য।


তারপর অনেক গুলো দিন কেটে গেছে, এই শহরে নীরা ফিরে এসেছে। হাসান ঢাকা কলেজের উল্টো পাশের রাস্তা ধরে নীলক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায়, তার বাম হাতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটা লাঠি। মারাত্মক কিছু হতে পারত, বেঁচে গেছে কিছু আঘাতের উপর দিয়ে। কয়েক মাস এখন লাঠির সঙ্গ উপভোগ করতে হবে, নতুন এক ধরনের অভিজ্ঞতা – কী আর করা।

আজকাল বিষণ্ণতার সাথে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে হাসানের একাকীত্ব! তার শুধু মনে হয়, নীরার খুব শীঘ্রই বিয়ে হয়ে যাবে, এই নীরা আর সেই নীরা থাকবে না। হাসান বাস্তবতা জানে, মানেও ... তবু মনের কোণে আশার প্রহেলিকা মাঝে মধ্যে দেখা দিয়ে যায়, কিচ্ছু করার নেই।

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়


নীরা হাসানকে বন্ধুর চেয়ে ‘একটুখানি’ বেশী কিছু ভাবতে পারেনি। মানুষের মন, বড় রহস্যময়! কোন সমাধান নেই। তারা বেশ ভাল বন্ধু, আর কিছু নয় – নীরা এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। হাসান কী সেটা বুঝতে পেরেছে? নাকি বুঝতে চায়নি! অথবা নীরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কেন ব্যর্থ হয়েছে?

আরেকবার সবকিছু হিসেব হওয়া দরকার। নীরা আজ বিকেলে সূর্যাস্তের ঠিক আগে হাসানের সাথে দেখা করবে। ভুল জানালায় কড়া নেড়ে যাওয়ার শেষ দেখতে হাসান আজ নীরার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে, উত্তর জানা চাই –

আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্নে দেখেছি যে তুমি
তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছো
এখনো কি সময় আছে তোমার জীবন্ত শরীর স্পর্শ করার
এবং যে ওষ্ঠ থেকে আমার অতি প্রিয় স্বর জন্ম নেয়
সেখানে চুম্বন দেবার?



[কবিতা গুলো সুনীলের]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন