একটু মায়া, একটু ভালোবাসা

“অর্ক, একটা সিগারেট খাব। দে।”
“তুই সিগারেট খাবি কোন দুঃখে?” রাতের আকাশের দিকে এক রাশ ধুঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে অর্ক।
“কোন দুঃখ-টুঃখ নাই। তোরে দিতে বলসি দিবি।” নিস্তব্ধ নিরবতায় শীতল শোনায় নিশিতার কন্ঠ।
“যা ভাগ।” বিরক্ত হয় অর্ক। ধুরো মেয়েটা শান্তিতে বিড়ি টানতে দিচ্ছে না।
“তোরে কিন্তু এক ধাক্কায় ছাঁদ থেকে ফেলে দেবো। লাস্টবারের মত চাইতেসি।” নিশিতার ক্যাটস আই জ্বলজ্বল করে।





ঘাড় ঘুড়িয়ে নিচের দিকে তাকায় অর্ক। অমাবস্যার রাতে বার তলার উপর থেকে ব্যস্ত রাস্তাটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অল্প কিছু গাড়ি চলছে। রাত এখন কত হবে? মনে হয় এগারটা। আধ খাওয়া বেনসনটা শূন্যে ছুড়ে মারে সে। মধ্যাকর্ষনের অতল টানে ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যায় ওটা।


“আমার কাছে আর নাই।”
“তুই ঐটা ফালাইলি ক্যান? ঐটাই টানতাম।”
“আমার ঠোঁটে লাগানো জিনিস তোকে দিবো ক্যান?”
“তোর কি এইডস হইসে যে ওটা খাওয়া যাবে না?”
“হৈতেও তো পারে। টেস্ট করাই নাই।”
“তুই এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে যাবি। নাইলে লাথথি দিয়ে তোরে সত্যি সত্যি ফেলে দিব।”

অর্ক এমনিতে একটা সুযোগ খুঁজতেছিল। রাত কম হয়নি। সে শিস বাজাতে বাজাতে ছাঁদ থেকে চলে গেল।

নিশিতা চুপচাপ অর্কের চলে যাওয়া দেখে। তারপর আস্তে করে উঠে হাঁটতে শুরু করে। এই যে হাঁটা শুরু হল কখন থামবে কেউ জানে না। একঘন্টা চলতে পারে, দুঘন্টা চলতে পারে কিংবা যতক্ষন পা চলে। একমাত্র বিধাতা বলে যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি হয়তো জানবেন কখন নিশিতা থামবে এবং ঘুমুতে যাবে।


“শীতলক্ষ্যা” অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে অর্ক আরেকটা সিগারেট ধরায়। শান্তিনগরের শান্ত রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। রাতে খাওয়া হয় নি। নিশিতা আজকে সন্ধ্যা থেকে কিছু খাওয়ায় নি। সারাটাক্ষন ঝিম মেরে বসে ছিল। অথচ প্রায় রোজরাতে সে ঐ বাসায় যায় ভালমন্দ কিছু খেয়ে আসার জন্য। নিজে থেকে অবশ্য যায় না। যেদিন ফোন আসে সেদিন যায়। খাওয়ার যায়গার তো আর অভাব নেই। বড়লোক বন্ধুবান্ধব তার সব। ছোটলোকের মধ্যে আছে খালি মফিজ। ভর্তা-ভাজি-ভুজি এসব খেতে ওখানে যাওয়া যেতে পারে। এসব ছাইপাশ খাওয়ার আরেকটা জায়গা আছে। মীনা ফুফুর বাসা। কিন্তু ঐখানে বছরখানেক ধরে সুবিধা হচ্ছে না। ফুফাত বোন মিলি তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। মনে হয় পারলে মেয়েটা চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবে।


মোবাইল বাজে টুং টাং।
“(অশ্লীল গালি) কই তুই?”
“রাস্তায়।”
“বাসায় আয়, বোতল আছে।”
“উখে, টাইম পাইলে আসুম নে।”
“শালা, তোর আবার টাইম কিরে? বারটার মধ্যে আয়। মেইন গেট লাগায়া দিবে।”

লাইন কেটে দেয় অর্ক। আজকে বোতল খেতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কিছু খাওয়া দরকার। আলুভর্তা হলে সবচেয়ে ভাল হয়। সাথে একটু ঘি। ক্ষুধা ব্যাপারটা অর্কের মধ্যে নাই। কিন্তু একবার কোনকিছু মাথায় ঢুকলে খবর আছে। এই এখন যেমন হাটার গতি আচমকা বেড়ে গেছে।


খিলগাও তিলপাপাড়ায় আড়াইতলা কালশিটে পরা একটা বিল্ডিং এর সামনে অর্ক দাঁড়িয়ে আছে। ফুফাসাহেব মারা যাবার আগে বাড়িটাকে ঠিক এই অবস্থাতে রেখে গেছেন। এরপর আর কোন সংস্কার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়নি। মীনা ফুফু কোন ঝামেলার মধ্যে নেই। তার একমাত্র চিন্তা মেয়ে দুটোকে ভালভাবে সুপাত্রস্থ করা। এরপর তিনি নিশ্চিন্তে হজ্বে চলে যাবেন। বাকী জীবন আল্লাহর পথে কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা। অর্ককে তিনি বড় ভালবাসেন। একা মহিলা মানুষ, দুটো মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হন। সবকথা তিনি অর্কের সাথে শেয়ার করেন, যদিও অর্ক আজ পর্যন্ত তার কোন কাজে আসেনি।


রাত এখন অনেক। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিল্ডিংটাকে ভুতুড়ে লাগছে, কোন বাতি জ্বলে নেই। গলির সোডিয়াম বাতিটা নষ্ট, অর্ক কোনদিন একে জ্বলতে দেখেনি। মোবাইলটা বের করে মিলিকে কল দেয়। রিং হতে থাকে, হতে থাকে। প্রথমবারে মিলি কখনো কল রিসিভ করে না। আবার কেটেও দেয় না। দ্বিতীয়বারে রিসিভ করে। এটা মিলির স্টাইল। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু তার সাথেই ঘটে কিনা যাচাই করে দেখেনি অর্ক।

“হ্যালো মিলি!”
“হুম বলছি।”
“নিচের গেট খুলে দাও। আমি আসছি।”

ফোন রেখে দিয়েছে মিলি। বেশী কথা বলার অভ্যাস নেই তার। অর্কের সাথে কথা বলে আরো কম। গেট খুলতে খুলতে মিলির প্রথম কথা সবসময় অনেকটা একইরকম, “এত রাতে আসছেন ক্যানো?” অর্কের উত্তরটা একদম নির্দিষ্ট, “তোমাকে দেখতে আসছি।”

“ক্যানো দেশে কি সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়ছে?”
“না আরো বাড়ছে। কিন্তু সবগুলো আর্টিফিসিয়াল, প্রাকৃতিক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।”
“প্রাকৃতিক জিনিস দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“গায়ে মাখবো।”
“ফালতু কথা আমার সাথে বলবেন না। ফালতু প্যাচাল আপনার ফুফুর সাথে গিয়ে করেন।”
“ফুফু কই? শেলী কি করে?”
“আপনি ভাল করেই জানেন আপনার ফুফু রাত দশটার সময় ঘুমায়। সে হিসেবে তার এখন ঘুমের তৃতীয় স্তরে থাকার কথা। শেলী এফ এম শুনতেসে।”
“এফ এম সেটাতো ভাল জিনিস। তুমি এফ এম শুনলে আমি আর জ়ে হওয়ার একটা ট্রাই নিতাম।”
“রেডিও শোনার মত দুর্মতি আমার হয় নাই। সামনের রুম গোছানো আছে। আপনি ঘুমাতে গেলে ভাল হয়।”

মেয়েরা নিষ্ঠুর হয়, পাষান হয়, হৃদয়হীনা হয়। কিন্তু কতটা হয় সেটা মিলিকে দেখলে বোঝা যেতে পারে। অর্ক করুন স্বরে বলে, “মিলি একটা কথা আছে।”
মিলি সরু চোখে তাকায়, “কি?”
“ভাত খাব।”

এতক্ষনের রুক্ষ শুষ্ক কন্ঠস্বরে একটু আদ্রতা, প্রানের ছোঁয়া পাওয়া যায়, “ভাত নাই। আপনি বসেন একটু। আমি এখনি চড়িয়ে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
“আর কি খাবেন? বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছের তরকারী আছে।”
“আলু ভর্তা খাব।”
“ঠিক আছে।”
“সাথে একটু ঘি।”
“আচ্ছা দিবো।” (এই প্রথম মিলির ঠোটের কোনায় ছোট্ট করে হাসি দেখা যায়।)


মোবাইল বাজে টুং টাং।
“কি করিস?”
“হিন্দী সিরিয়াল দেখি। তুই কি করিস?”
“তুই সিরিয়াল দেখিস কোন দুঃখে!”
“এমনি বসে আছি। ভাবলাম অভিনয় শিখি।”
“তুই অভিনয় শিখতেছিস ওদের কাছ থেকে!! ভাল।”
“বাদ দে। তুই কি এখনো ছাদে?”
“মাত্থা খারাপ। আমি এখন শ্রীকান্ত শুনতেসি আর চা খাচ্ছি।”
“গুড। আরো ভালো হয় ঘুমাতে গেলে। শ্রীকান্তের চেয়ে কাজে দিবে।”
“আমার ভাল আমি বুঝবো। আমারে উপদেশ দিবি না। উপদেশ একদম ভাল্লাগে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” (দীর্ঘশ্বাস)
“তোকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করছি।” (ভয়েজটা আস্তে শুনায়)
“কি কথা?”
“অর্ক, আই অ্যাম সরি।” (আরো আস্তে)
“সরি ক্যান?”
“তোকে বাজে বিহেভ করে তাড়ায়া দিছি। সারাদিন কিছু খাওয়াই নাই। আসলে আমার মাথা ঠিক ছিল না আজকে। সরি দোস্ত। আর কখনো এমন হবে না।”
“ইটস ওকে। তোর মাথা কোনদিনই ঠিক হবে না।”
“তোরে বলসে। তুই কি এখনো না খাওয়া? তাহলে চলে আয়।”
“আমি একটু পর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাব।”
“আলুভর্তা ওয়াও!! আমারো খাইতে ইচ্ছে করতেসে।”
“নিজে বানায়া খা। কিচেনে গিয়ে চুলা ধরিয়ে দুটা আলু সিদ্ধ দে। এই ফাঁকে পেয়াজ, কাচামরিচ, ধনিয়া-পাতা কুচি কুচি করে কেটে ফেল। আলু সিদ্ধ হয়ে গেলে একসাথে চটকে গরম ভাত যোগে খেতে বস। সাথে ঘি নিলে আলাদা টেস্ট পাবি আশা করা যায়।”
“এখন এতকিছু করতে পারবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে। বাই।”


অর্ক জানে, নিশিতা এখন আলুভর্তা বানানোর ট্রাই নেবে। এই মেয়েকে সে চা বানানো শিখিয়েছে, ডিমভাজা শিখিয়েছে। আলুভর্তাও সে বানাতে পারবে। শুধু প্রাকটিস দরকার। মেয়েমানুষ এসব না পারলে কেমনে হবে? নিশিতার বাবা-মা তাকে অকর্মার ঢেকি বানাতে চেয়েছে। সে কাজে তারা পুরোপুরি সফল। নিশিতা বাবাকে ঘৃনা করে কিন্তু বাবার প্রাচুর্যের বাইরে ২৪ঘন্টা কাটানোর ক্ষমতা তার নেই। ১০কদম হাটতে গেলে তার গাড়ি লাগে, দেশী খাবার খেলে বমি আসে। তবু সে মুক্তি চায়। এই দুঃসহ জীবন থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে আসতে চায়। হয়তো সে পারবে কিংবা পারবে না। সময়ের অপেক্ষা।


মিলি এসে ভাত খেতে ডাকে। অর্ক খেতে বসে। মিলি বসে তার মুখোমুখি। দুজনের সামনে দুটো প্লেটে সুন্দর করে গরম ভাত, আলুভর্তা, আস্ত কাচামরিচ আর পেয়াজের টুকরো সাজানো। মাঝখানে একটা ঘিয়ের বৈয়াম, তার উপরে উলটো করে রাখা চামচ। টেবিলের দুপাশে দুটো মোমবাতি জ্বলছে। গরম ভাতের ধুয়ো উড়ছে। মন উথাল-পাথাল করা স্বর্গীয় পরিবেশ। দুজনের কেউ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। মাথা নিচু করে বসে আছে। উপর থেকে কেউ একজন এসব ভাব-বিনিময় দেখে মুচকি হাসেন। লাইফ ইজ সো রোমান্টিক!

২টি মন্তব্য: