লাইফ অফ লকডাউন

করোনা-বন্দী জীবন শেষ হলে আমি মায়ের কাছে যাব। মায়ের হাতে রান্না লাল শাক আর গরুর মাংস ভুনা দিয়ে ভাত খাব। এই ঈদে বাড়ী যাবার কথা ছিল, জানি সম্ভব না। হয়ত পরের ঈদে বাবার সাথে আবার নামাজে যাব। আমার ভাই কে নিয়ে বুফে খেতে যাব, কোনদিন যাওয়া হয় নাই এক সাথে। নিতান্তই স্বাভাবিক কিছু চাহিদা আমার জন্য এখন অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার মনে হচ্ছে। প্রিজন ব্রেক বা শশাঙ্ক রেডেম্পশন মুভির মত অবিশ্বাস্য কিছু করে অর্জন করতে হবে এমন একটা অবস্থা।

কে জানে দেশে গেলে প্রবাসী হিসেবে ধাওয়া খেতে হতে পারে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে যাওয়া যাবে না, এমনকি মানুষ বাড়ী ছাড়াও করতে পারে – এটাই এখন স্বাভাবিক ঘটনা। কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করা যাবে না, কিছু অবিবেচকের জন্য প্রবাসীদের যে নবাবজাদা ইমেজ পাবলিকের মনে গেঁথে বসেছে, করোনা পরবর্তী যুগে সেই রেশ থেকে যাবে। মানুষজন বেফাঁস বলে ফেলতে পারে – আরে মিয়া আপনাদের জন্যই আজকে এই দুর্দশা দিন দেখতে হল, ঐ ইহুদী নাসারাদের দেশ থেকে বেঁচে ফিরলেন কেমনে?
প্রবাসী কোন তারকার পোস্টের কমেন্ট দেখলে বোঝা যায় আমজনতা কী পরিমাণ ঘৃণার চোখে দেখে বিদেশীদের। দেশ ছাড়ার পর দেশ নিয়ে কিছু বলার আগে আমি সদা-সচেতন থাকি, সবসময় নিজের অবস্থান সবার কাছে ক্লিয়ার করি – ভাই, আমার কোন দেশপ্রেম নাই, থাকার কারণ ও নাই। আমার ফ্যামিলি আছে দেশে, তাদের দেখাশোনা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, আর এক্সট্রা কিছু দেশের জন্য করি না। আমার কয়েকজন বন্ধু আছে দেশে গেলে যা কিছু খাওয়া হয় পোস্ট দিয়ে জানান দেয়, দোষের কিছু না – স্মৃতি হিসেবে টাইম লাইনে থাকে, পরের বছর ফেইসবুক নিজ দায়িত্বে মনে করিয়ে দেয়। আমি তাদের দেখে লিস্ট বানিয়ে রেখেছিলাম, করোনা-বন্দী শেষ হলে সেই চেকলিস্ট বাস্তবায়ন করব ইনশাল্লাহ।

সিঙ্গাপুরে থাকার সুবাদে তাদের প্রধানমন্ত্রী আর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের জানার সুযোগ হল। আর জন্ম থেকে দেখে আসতেছি আমার দেশের পলিটিশিয়ানসদের। উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু, হায় এরাও মানুষ তারাও মানুষ! লিডারশীপ যে একটা ছোট্ট স্টার্টআপ থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট পর্যন্ত কত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিয়ত শিখতেছি। কাজ অনেকে করতে পারে, করতে চায়, কিন্তু কাজ সিস্টেমের মধ্যে ফেলে করায় নেয়া বড় কঠিন ব্যাপার।

থাক কঠিন বিষয় বাদ দেই, করোনা বিদায় নিলে কার সাথে কফি খেতে যাব সেটা নিয়ে ভাবা যাক। আসল কথা হল আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এবং পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ সুস্থ থাকুক, বিরিয়ানির দাওয়াতের অভাব হবে না। আমি বরং অপেক্ষায় থাকি কবে আবার সমুদ্রে যাব, সুদূর পাহাড়ের মেঘের ভিতর হারিয়ে যাব। তার আগে অবশ্যই মানুষ হব, নিজেকে পরিবর্তনের নিজেকে চেনার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।

করোনা টাইমে আমি কয়েকজন মানুষের কথা জানলাম। তাদের দেখে আমার চিন্তা ভাবনা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখতেছি। একজন হলেন বাদল সৈয়দ। পেশায় তিনি ট্যাক্স কমিশনার, নেশায় কথা সাহিত্যিক আর মননে স্বেচ্ছাসেবক। মায়া ছড়ানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন Pay It Forward Bangladesh এবং Honest নামে দুটো সংগঠনের মাধ্যমে। আর একজন চন্দ্রনাথ। গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার এবং অবশ্যই আপাদমস্তক স্বেচ্ছাসেবক। উনি আমার ভার্সিটির বড় ভাই বলে গর্ব বোধ করি। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ সংগঠন চলছে চন্দ্রনাথ ভাইয়ের নেতৃত্বে। এই দুইজন মহান মানুষ তাদের সংগঠনের রেগুলার স্বেচ্ছাসেবী কাজকর্মের পাশে শুরু করলেন পিপিই ক্রাইসিসে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। স্যালুট জানাই তাদের সাথে আরো যারা আছেন এই অসম্ভব কঠিন কাজে। কিশোর কুমার দাস - বিদ্যানন্দ, এক টাকায় আহার এবং আর শতাধিক ভলান্টিয়ারি কাজ যার ব্রেইন চাইল্ড। আমার মনে হয় সারা দেশের মানুষ এখন বিদ্যানন্দ কে চেনে আর একটু একটু করে হলেও ডোনেশন দিয়ে তাদের পাশে আছে। আমি এবং আমরাও আছি থাকব ইনশাল্লাহ।

লকডাউনে বদ্ধ থেকে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করছি। বাদল সৈয়দ ভাইয়ের একটা কথা কানে লেগে আছে – মানুষের জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক, না করাটা অস্বাভাবিক এবং এগুলা কোন বড় কাজ না, করতে হবে। ‘দেশের টাকায় ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি’ – এই বিষয় কোনদিন আমার মাথায় আসে নাই। আসলে কথা সত্য, ১০ টাকা বেতনে সরকারী স্কুলে পড়েছি, নটরডেম আর বুয়েটে আমার সময় খরচ খুব কমই ছিল, এখন যে ডলারে কামাই তার ফাউন্ডেশন কে দিয়েছে? সাধারণ মানুষের হক আছে আমাদের উপর। যাকাত দেই, দিব নিয়ম মাফিক এবং নিয়ত করছি এই মহৎ মানুষদের কার্যক্রমে খুব সামান্য হলেও নিয়মিত ডোনেট করে যাব, সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার মত শুদ্ধ এখনো হতে পারি নাই, সময় লাগবে। ঋণ পরিশোধ কিংবা করোনা থেকে পাপ মোচন। মানুষ হওয়ার চেষ্টা জারি থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন