গৃহবন্দী দু’জন

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাতটা চল্লিশ। আকাশে গাঢ় অমানিশা, খুব বৃষ্টি হবে মনে হয় আজ। তমাল আয়োজন করে রুমের ভেতর থেকে চেয়ার এনে বারান্দায় বসে। বৃষ্টির সাথে সাথে গান শুনতে বেশ লাগে। এমনিতে গান শোনার অবসর হয় না, আজকাল অখণ্ড অবসর পাওয়া যায়। ইউটিউব থেকে র্যান্ডম একটা ট্রেন্ডি গান ছাড়ে। মৌলিক গান পারবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু এই নোবেল ছেলেটা গানের কভার ভালই করে। তার সিলেকশন ভাল।
কেউ না জানুক মন তো জানে / মনের ও যে কষ্ট আছে / সেই বেদনা লুকিয়ে রাখি হাজার ছলনায় …
মানুষ বলে জীবন খাতায় / ভুলের হিসেব পাতায় পাতায় / দূরের থেকে ভালো সবই, কাছে গেলে নাই …
যখন দেখি চাওয়া পাওয়া শূন্যতে মিলায় / তখন আমি এই শহরে কষ্ট বেঁচে খাই।

ঢাকা শহরের বাসা যেমন হয় পাশাপাশি কাছাকাছি। পাশের বিল্ডিং এর পাশাপাশি বারান্দায় তখন রিমি ও গান শুনছে। হাল্কা আলো আধারিতে খুব পরিষ্কার চেহারা বোঝা যায় না। রিমি খেয়াল করেছে এই ছেলেটা বারান্দায় এসে সন্ধ্যার পরে বসে। লকডাউনের আগে কখনো বসতে দেখেছে মনে পড়ে না। সে নিজেও কালে ভদ্রে এসে বারান্দায় বসত আগে, সারাদিনের জ্যাম আর ভার্সিটির প্যারা শেষে এমন অদ্ভুত অবসর বহুদিন হয় নাই। রিমির মাথায় হঠাত কী খেয়াল চাপে সে ঠিক করল ছেলেটার সাথে কথা বলবে। নরমাল টাইমে হলে এই কাজ করার আগে সে হয়ত একশবার ভেবে দেখবে, এখন সময় অস্বাভাবিক।
হ্যালো এই যে শুনছেন। হ্যালো।
কানে হেডফোন, শোনার কোন উপায় নাই। তারপরেও তমাল মনে হয় ভুত দেখল। পাশের বাসার মেয়ে যাকে সে কোনদিন চিনে না জানে না, গ্রিলের সাথে মাথা লাগিয়ে হাত নেড়ে মনে হয় তাকে ডাকছে। প্রথমে তমাল ভাবল – ঠিক আছে মনে হয় চোখের ভুল, পরে মনে হল হয়ত মেয়েটা বিপদে পড়ে ডাকতেছে। ইয়ারফোন খুলে সে গ্রিলের দিকে এগিয়ে গেল।
জ্বী আমাকে বলছেন? কোনো সমস্যা?
মেয়েটা মনে হয় হাসল – নাহ কোন সমস্যা নাই। এমনি আপনাকে ডাকলাম।
এই লাইট-বিহীন বারান্দার আলো আধারিতে ঠিক বোঝা গেল না মেয়েটার হাসি কেমন – সুন্দর / অসুন্দর নাকি রহস্যময়।
আচ্ছা কেন ডাকছেন বলেন আপু।
আরে ভাই এমনি। দেখলাম আপনি বারান্দায় আজাইরা বসে আছেন।
আমিও আজাইরা বসে আছি। অনেক দিন বসে আছি মনে হয়, অনেক বছর ধরে বসে আছি। ভাবলাম চিনি না জানি না এমন একজনের সাথে গল্প করি। আর হাতের কাছে আপনার থেকে ভাল অপশন কই?
তমাল চুপচাপ ভাবে হয়ত মেয়েটা পাগল অথবা ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে সামনে পাগল হবে। গল্প করতে অবশ্য খারাপ লাগবে না, সমস্যা হল সে বেশীক্ষণ কথা বলতে পারে না - নার্ভাসনেস, কথা হারায় ফেলে লম্বা করতে পারে না। এটা মেয়েদের সাথে না, সবার সাথেই, তার ছোটবেলা থেকে কনফিডেন্সের অভাব।
কী ভাবেন? অচেনা মেয়ের সাথে গল্প করতে কোন অসুবিধা আছে?
জ্বী না। বলেন কী গল্প করা যায়।
এই তো লাইনে আসছেন ভাই। শোনেন গল্পের এক এবং একমাত্র রুল হল আমি বা আপনি কে, কী করি, ফ্যামিলিতে কে কে আছে, করোনা নিয়া কী ভাবছেন এইসব গল্প আমরা করব না।
তমালের মাথা ঘামানো শুরু করছে এই ঠাণ্ডা বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়ায়, এমনিতে সে কথা বাড়াতে পারে না, তার উপরে টপিক লিমিটেশন।
হুমম… আচ্ছা কী গল্প করবেন?
ছোটবেলায় আলিফ লায়লা দেখছেন?
জ্বী দেখছি অবশ্যই।
ঠিক আছে অনেকটা সেরকম। আপনি আমাকে একটা গল্প বলেন যেকোন কিছু আপনার নিজের হতে পারে বা অন্য কারো… না হলে বানায় বলতে পারেন। আমিও আপনাকে একটা গল্প বলব।
ইন্টারেস্টিং আইডিয়া। আপনি প্রথমে বলেন, তারপর আমি আপনাকে গল্প শুনালাম না হয়।
ওকে নো প্রবলেম। শোনেন যার গল্প বলছি তার নাম সুমি, আমার খুব ক্লোজ বান্ধবী – জানের দোস্ত।
আচ্ছা আমরা এইভাবে ওপেন প্লেসে গল্প করব, আশেপাশের মানুষ কী ভাববে? আপনার বাসায় কেউ কিছু বলবে না?
আরে রাখেন ভাবাভাবি, এখন মানুষ বাঁচা-মরা নিয়ে টেনশনে আছে। আরা আমার বাসায় কেউ আমাকে ঘাঁটানোর সাহস পায় না। আপনাকে কেউ বকবে ভাই?
নাহ, আমি বাসায় একা। আমার বন্ধু যার সাথে থাকি, সে বাড়ী চলে গেছে।
ও তাহলে তো হলোই… টেনশন নিয়েন না, আমরা প্রেম করছি না, জাস্ট টাইমপাস। আসেন গল্প শুরু করি।
সুমি পড়াশোনায় প্রচণ্ড ফাঁকিবাজ একটা মেয়ে। তার বাবার টাকা পয়সা মাশাল্লাহ, পড়াশুনা করে সে এমন হাতি ঘোড়া অর্জন করবে না, তেমন ইচ্ছাও নাই। কিন্তু তার বাবার ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে। বাবা ডাক্তার, ছেলে মেয়ে কেউ ডাক্তার হতে পারেনি, সুমি হল তার হাতের শেষ সম্বল। একরকম জোর করে বাবা মেয়েকে সায়েন্স পড়তে দিয়েছে। ক্লাস নাইনে টেনেটুনে পাশ। ক্লাস টেনে এখন সুমি। সামনে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা। আজমল সাহেব ব্যাপক টেনশনে আছেন। যেই মেয়েকে দিয়ে ডাক্তারী পড়ানোর স্বপ্ন তার এসএসসি পাশ-ফেল নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।
গৃহ-শিক্ষক আসে যায়, কেউ দু’মাসের বেশী টেকে না। টাকা-পয়সা প্রয়োজন, তাই বলে ছাত্রী পড়াতে এসে কত আর হেনস্তা হওয়া যায়। পাশ করানো আরো পরের ব্যাপার। টিচার এসে বসে থাকে। ঘন্টাখানেক পরে বুয়া এসে জানান দেয়, আফায় আজ পড়ত না। মুড নাই। মাথা ব্যথা। ইত্যাদি। আজমল সাহেবের চিৎকার চেঁচামেচিতে যদিবা বাধ্য হয়ে পড়তে আসে, টেবিলে বসে ঘুমায়। মোটকথা টিচারের ধৈর্য্যশক্তির চূড়ান্ত পরীক্ষা। মেয়েকে বদলানো সম্ভব না, আজমল সাহেব কোচিং এর ম্যানেজার কে গিয়ে ধরলেন – এমন একজন টিচার দিতে হবে যে টিউশনি ছেড়ে যাবে না।
সুমি কে পড়াতে আসলেন মিজান স্যার। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স, টিউশনি করে আর চাকরী খোঁজে। মিজান স্যার সপ্তাহে চারদিন সকাল আটটায় এসে সুমিদের বাসায় কলিংবেল দেয়, বাসার সবাই মানে বুয়া সহ সবাই তখনো ঘুমে। মিজানের কারণে বাসার লোকজনের হয়ত ঘুম ভাঙ্গে। ড্রয়িং রুমে বসে সে এসির বাতাস খায় আর বিশাল একুয়ারিয়াম দেখে। মাঝে মধ্যে নিজের সাথে থাকা কারেন্ট এফেয়ার্স আর সুমির বাসায় দেয়া প্রথম আলো পড়ে। নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে নাস্তার জন্য মিজানের ডাক পড়ে ডাইনিং রুমে। পাউরুটি আনলিমিটেড, জ্যাম-জেলি, ডিম সিদ্ধ, কলা। মাঝে মধ্যে পরোটা, ভাজি, হালুয়া, মাংস। ভাল স্বাস্থ্যসম্মত নাস্তার সরবরাহ থাকে স্যারের জন্য প্রতিদিন। সুমির মন চাইলে দু-একদিন সপ্তাহে পড়তে আসে, এগারটা পর্যন্ত থেকে মিজান চলে যায়।
মাস খানেক যাবার পরেও স্যারের কোন ভাবগতিক পরিবর্তন নাই দেখে সুমির মেজাজ খারাপ।
আচ্ছা স্যার, আপনার কোন লজ্জা-শরম নাই? প্রতিদিন এগারটা বাজায়ে তারপরে যান কেন?
মিজান মাথা নিচু করে বলে, এগারটা পর্যন্ত আমার আর কোন কাজ নাই, সকালে একটাই টিউশনি। বিকালে কোচিং এ পড়াবো, সন্ধ্যায় আবার টিউশনি। তোমার অসুবিধা করতেছি না। ভাল লাগলে পড়বা, না ইচ্ছা করলে পড়বা না। আমি শুক্র-শনি, সোম-মঙ্গল চারদিন এগারটা পর্যন্ত থাকব।
আমার আপনার পড়ানো ভাল লাগেনা। আপনে তেমন বুঝাতে পারেন না, বেসিকে সমস্যা।
মিজান হাসে। তোমার কোন স্যারের পড়ানো ভাল লাগে না। এই রিপোর্ট শুরু থেকে আমার কাছে আছে। তোমার ভাল না লাগলে অসুবিধা নাই, তোমার বাবা বেতন চালিয়ে গেলে আমি কন্টিনিউ করব।
সুমি এবার আরো ইনসাল্ট করবে ঠিক করে। দেখেন স্যার, বুয়া পর্যন্ত আপনাকে দেখে হাসে। বলে আপনার স্যার আসছে খাইতে, এমন খাওন খায় মনে হয় কোরমা পোলাউ খাইতাছে, বিয়া বাড়িতে আসছে খাইতে।
মিজান চুপচাপ। খাওয়ার খোটা কষ্টকর। কিন্তু বুয়া মিথ্যা বলে নাই। সে আস্তে আস্তে বলে, সুমি শোনো, টিউশনিতে নাস্তা খেলে আমার খাওয়ার খরচ বেঁচে যায়। তোমাদের বাসার নাস্তার পরিমাণ ভাল। মাঝে মধ্যে আমি আর লাঞ্চ করি না। সোজা কোচিং পড়াতে চলে যাই। অনেক বাসায় আছে শুধু চা-বিস্কিট দেয়, সেটাও আমি শেষ করি। আমার চায়ের খরচ বেঁচে যায়। মেসের খাবার সুবিধার না, বাসা-বাড়ীর খাবার খেতে আমার ভাল লাগে সত্যি কথা।
সুমি কথা না বাড়ায়ে সামনে থেকে চলে যায়। সে বুঝে গেছে মিজান স্যার সেইরকম বিরক্তিকর, ইনি সহজে যাবেন না।
তারপর হঠাত সুমির ডেঙ্গু জ্বর হয়। বিছানা থেকে উঠতে পারে না, স্যালাইন দিতে হচ্ছে। মিজান স্যার নিয়ম মাফিক আসে আর এগারটার আগে বাসা থেকে যায় না।
সুমি স্যার কে রুমে ডাকে। মিজান সুমির বিছানার পাশে চেয়ার পেতে বসে, আগে কখনো এই রুমে আসেনি সে। সবসময় ডাইনিং এ নাস্তা করে, সুমি সেখানে বই-খাতা নিয়ে যায়। ছাত্রীর মুখ চোখ শুকনো অবস্থা দেখে মিজানের খারাপ লাগে – সুমি কেমন আছো এখন?
স্যার দেখতেই তো পাচ্ছেন। আরো এক সপ্তাহ বেডরেস্ট থাকতে হবে। আপনি কেন বসে থাকেন স্যার? নাস্তা করে চলে যান প্লিজ। বিরক্ত লাগে খুব।
আচ্ছা আমি ড্রয়িং রুমে বসে থাকলে তোমার অসুবিধা কী? বাইরে প্রচণ্ড গরম দুপুর বেলা, ঠাণ্ডার মধ্যে বসে পেপার পড়ি।
স্যার আপনি অপেক্ষা করে বসে থাকলে আমার ব্রেইনে চাপ পড়ে।
তাহলে আমি কী করব? মিজান অসহায় ভাবে সুমির দিকে তাকায়।
সুমি সেই দিকে তাকিয়ে কী বলবে ভেবে পায় না। অনেক ক্ষণ পরে বলে, আচ্ছা আপনি ফিজিক্সের একটা চ্যাপ্টার ধরে বোঝানো শুরু করেন। এই সাবজেক্ট শুধু আপনি ভাল বুঝেন। আমি চোখ বন্ধ করে শুনতেছি।
জ্বর ভাল হবার পর সুমি রেগুলার পড়তে বসে স্যারের কাছে। ভেজাল করা বাদ দেয়, বুঝে গেছে লাভ নাই। মিজান একদিন জিজ্ঞেস করে, সুমি তোমার মাথা শার্প, সামান্য পড়লে তোমার হয়ে যায় যা আরেকজন এভারেজ স্টুডেন্টের দশগুন সময় লাগবে, এরপরেও তোমার পড়াশুনা নিয়ে এত অনীহা কেন?
দেখেন স্যার, বাবার উপরে অভিমান করে মা আরেকজনকে বিয়ে করে ভেগে গেছে। আমার বড় ভাই বিদেশে পড়ার নাম করে চলে গেছে, আর কোনদিন আসার সম্ভাবনা নাই। আমার আরেকটা ভাই আছে, এই বাসাতেই আছে। আপনি তাকে কোনদিন দেখেন নাই, দেখবেন ও না। সে তার রুমের মধ্যে থাকে, খায়, ঘুমায়, একদিন হয়ত মারা যাবে রুমের মধ্যে। আমি তাদের মত এত স্বার্থপর কিছু করতে পারব না, তাই জাস্ট পড়াশুনা বাদ দিয়ে বসে থাকি।
তোমার বাবার দোষ কী ছিল?
তার আসলে কোন দোষ নাই – ঐটাই সবথেকে বড় দোষ। আজমল সুবহান বাংলাদেশের নামকরা ক্যান্সার স্পেশালিষ্ট। সে রাতে বাসায় ফেরে দুইটা-তিনটার পর, আবার সকাল দশটার পর থেকে তাকে সারাদিন বাসাতে পাওয়া যাবে না। এমন লোকের সংসারে কে থাকবে বলেন স্যার? এই যে আমি পড়াশুনা করি না এইজন্য বাবা আমাকে নিয়ে একটু ভাবে, ঠিকঠাক থাকলে আমার কথাও ভুলে যাবে।
সুমি তুমি জানো না কত সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ। আমার বাবা কৃষক, নিজের জায়গা জমি নাই, পরের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। কোন কোন বছর বাবা কোন কাজ পায় না। আমরা পাঁচ ভাই-বোন নিজেদের খরচ নিজেরা ব্যবস্থা করি। আমার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবো, গ্রামে অনেক নাম-ডাক হবে। মেডিকেলে চান্স পেলাম না, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলোনা। আর তোমার কথা ভাবো, শুধু ভাল একটা রেজাল্ট করলে তুমি নিশ্চিত ডাক্তার হতে পারবে। সরকারী মেডিকেলে চান্স না পেলে তোমার বাবা প্রাইভেটে তোমাকে পড়াতে পারবেন। নিশ্চিত জীবন তোমার সামনে পড়ে আছে।
স্যার আমার বাবা বিখ্যাত ডাক্তার হয়ে জীবনে কি পেলেন? তার কোন অবসর নাই, ফ্যামিলি নাই, বন্ধু-বান্ধব নাই, কিছু নাই। আমি এমন শূন্য জীবন চাই না।
আচ্ছা তুমি কেমন জীবন চাও?
আমি মাস্তি করতে চাই লাইফে। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরব। অনেক অনেক মুভি দেখব। বই পড়ব। কবিতা পড়ব, কবিতা লিখব। ঝুম বৃষ্টি হলে ভিজতে নামব।
তারপর বৃষ্টি শেষ হলে কী করবে? সুমি তুমি এখন স্কুলে পড়ো, তোমার চিন্তা-ভাবনার জগতটা অনেক ছোট। গল্প-কবিতা-সিনেমার পরেও একটা স্টেজ আছে। সেটা হল কর্ম জীবন, তোমার আইডেন্টিটি। একটা সময়ে তোমাকে কাজ নিয়ে একটা লম্বা সময় পার করতে হবে, সেইটাকে এঞ্জয় করতে পারলে ভাল, আর না হলে বিনোদন অর্থহীন লাগবে।
সুমির টেস্ট পরীক্ষার কিছুদিন আগে মিজান স্যার এক সন্ধ্যায় বাসার টিএন্ডটি নম্বরে ফোন দেয়। সুমি, একটা গুড নিউজ আছে, আমার একটা চাকরী হয়েছে, প্রথম তিনমাস প্রবেশন পিরিয়ড। উত্তরাতে অফিস।
কংগ্রাচুলেশনস স্যার। আপনার আর এগারটা পর্যন্ত বসে বসে বাতাস খেতে হবে না আমাদের বাসায়।
হ্যাঁ সুমি, আংকেলকে ফোন করে বলব ভাবছি। সামনের সপ্তাহ থেকে তোমাকে পড়াতে পারব না।
স্যার কী বলেন? আপনি কি চান আমি টেস্ট পরীক্ষায় না বসি?
মানে কী? কি বলো এইসব? আমি অবশ্যই কোচিং থেকে আরেকজন টিচার সেট করে দিয়ে যাব।
স্যার আপনি যদি আর না আসেন আমি পরীক্ষাটা দিব না। সিরিয়াসলি বললাম। সুমি ফোন রেখে দেয়।
পরের দিন মিজান পড়াতে আসে। সুমি চুপচাপ কোন কথা বলে না।
সুমি চাকরী টা আমাকে করতে হবে। অফিস দশটায়, উত্তরা যেতে হলে আমাকে আটটায় রওনা দিতে হবে।
চাকরী করবেন স্যার। আপনাকে কে বাঁধা দিচ্ছে? আমাকে পড়ানোর পর নাস্তা করে অফিস যান।
মিজান ভেবে পায় না কী বলবে। কিভাবে সম্ভব সকালে টিউশনি করে অফিস করা।
ওকে, সকাল সাতটায় পড়াতে আসেন স্যার, আমি রেডি থাকব।
মিজান হাসে, যে ছাত্রী কে দশটায় টেবিলে পাওয়া যায় না সে পড়বে সকাল সাতটায়, তখন তার ঘুমের মধ্যরাত চলে।
সুমি টেস্টে ভালভাবে পাশ করে। আজমল সাহেব খুব খুশী, বেতন বাড়ায়ে দিলেন স্যারের। একটাই টিউশনি এখনো চলছে মিজানের, সে এই বড়লোকের খামখেয়ালী মেয়েটার মায়ায় পড়েছে মনে হয়, মেয়েটার খাতার কভারে সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা থাকে -
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা।
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই; পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি, এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা, শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
বাহ, খুব সুন্দর কবিতা সুমি। কে লিখেছে?
আপনি বলেন স্যার। গেস করেন।
তুমি লিখছ নাকি সুমি?
সুমি দুষ্ট হাসি দেয়। আহারে বোকা স্যার। জীবনে মনে হয় বাংলা পাঠ্য বইয়ের বাইরে কবিতা পড়ে নাই। কোন একদিন হয়ত জানবে এটা জীবনানন্দ দাশের কবিতা, তখন উনার মুখের অবস্থা দেখতে পারলে ভাল হত।
মিজানের প্রবেশন শেষ হয়। তার পারমানেন্ট পোস্টিং হয় চিটাগাং, বেতন ত্রিশ হাজার। মিজান আবার টিএন্ডটি নম্বরে ফোন করে, সে কালে ভদ্রেই সুমি কে ফোন করেছে।
স্যার আপনি আর কোনদিন আমাদের বাসায় আসবেন না। আর কোনদিন ফোন করবেন না। যদি করেন আমি কিন্তু একটা ঝামেলা করে ফেলব, মনে থাকে যেন।
সুমির সাথে মিজানের আর কোনদিন কথা হয়নি।


তারপর? – তমাল প্রশ্ন করে। এতক্ষণ সে একটানা গল্প শুনছিল।
তারপর গল্প শেষ – রিমির উত্তর।
বাহ খুব সুন্দর গল্প। আচ্ছা আপনি বান্ধবীর জীবনের এত ডিটেইলিং জানলেন কিভাবে? আপনার নাম কি সুমি?
রিমি বিরক্ত হয় – দেখেন ভাই, শুরুতে শর্ত ছিল যে পার্সোনাল প্রশ্ন করা যাবে না। গল্প হল গল্প, বানায়ে কল্পনা করে বললেই হল। নেন শুরু করেন, ইয়োর টার্ন।
তমাল চিন্তায় পড়েছে, কোন গল্প শোনানো যায় এই অচেনা মেয়েকে? আচ্ছা আজকে অনেক রাত হল, আরেক দিন বলি?
উহু না, বাকীর নাম ফাঁকি। ওকে টেইক এ চা-বিরতি।
কিছুক্ষণ পরে রিমি চায়ের কাপ নিয়ে আবার বারান্দায় আসে, চা খাবেন?
জ্বী খাওয়া যায়।
ওকে যান বানায় নিয়ে আসেন, চায়ের সাথে গল্প ভাল জমবে।
ইয়ে বাসায় চা শেষ, অসুবিধা নাই কয়েকদিন ধরেই চা খাওয়া হচ্ছে না।
নো প্রবলেম, ওয়েট আপনাকে টী-ব্যাগ দিচ্ছি, করোনার দিনে এইটুক আদান-প্রদান করাই যায়।
আমার বন্ধু কামাল ইন্টারে পড়ার সময় রুমন ভাইয়ের প্রেমিকা নীরার প্রেমে পড়ে।
রিমি হাসে – পরকীয়ার গল্প নাকি ভাই?
তমাল নার্ভাস – না মানে কামালের ক্রাশ নীরা রুমন ভাইয়ের প্রেমে পড়ে।
মানে কী?
আচ্ছা শুনেন তাহলে।


ক্লাস এইটে পড়ার সময় কোচিং এ কামাল দের ক্লাস নিতে আসে রুমন ভাই। বুয়েট, কম্পিউটার সায়েন্স, বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র। ভাইয়ের ভাব-সাব আলাদা। ম্যাথ বুঝান মনে হয় ম্যাজিকের মত। কামাল আর তার ক্লাসের সব ছেলে-মেয়ের মধ্যে রুমন ভাইয়ের অন্যরকম ক্রেজ। সেই সময় বিটিভিতে বাংলা ডাবিং ইংরেজি সিরিজের গোল্ডেন টাইম চলে, তখন রবিন হুড সিরিজ চলছে। রুমন ভাই কে দেখলে মনে হয় ঢাকার রবিন হুড, সেইম ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি।
স্কুলের ছেলেদের সামনে একটা আইডল লাগে, যাকে তারা গুরু মানে, ফলো করে। কামাল রুমন ভাই কে লাইফের আইডল মনে করে, চোখ বন্ধ করে ভাবে – বুয়েট কম্পিউটার সায়েন্স, আহা সব সুন্দরী মেয়েরা তার জন্য একদিন ফিদা হবে।
গল্পের এখানে এসে ফাস্ট ফরোয়ার্ডিং দুই বছর। কামাল এসএসসি তে ভাল রেজাল্ট করে নটরডেম কলেজে পড়ে। তার একটাই ধ্যান জ্ঞান বুয়েটে চান্স পেতে হবে। মামুন স্যারের বাসায় ম্যাথ পড়ে, গুহ স্যারের বাসায় কেমিস্ট্রি, এলাহি স্যারের কাছে ফিজিক্স।
কলেজে পড়ার সময়টা খুব রঙ্গিন, যা দেখি লাগে ভাল টাইপ অবস্থা। কামালের কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় ঢাকা শহরের সব সুন্দরী মেয়েরা গুহ স্যারের ব্যাচে পড়ে, স্যার টাইম মেইন্টেন করতে পারে না, একটা ব্যাচের শেষ হবার অপেক্ষায় পরের ব্যাচ ঘন্টা ধরে অপেক্ষা। সেই সময়টা আড্ডা দিয়ে মন্দ কাটে না। আর সবথেকে পিক টাইম যখন মেয়েদের ব্যাচ ছুটি হয়, ছেলেদের অপেক্ষা পূর্নতা পায়।
নীরা কে প্রথম গুহ স্যারের ব্যাচে দেখে কামাল। ফর্সা লম্বা সুন্দরী মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ‘তাল’ সিনেমার ঐশ্বরিয়া। কতজন স্যারের কাছে পড়ে, হয়ত পরের দিন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কামাল নীরার কথা ভুলে যেত। কিন্তু নীরার সাথে দেখা হয়ে যায় মামুন স্যারের বাসায়, একই ব্যাচে একই সাথে। আঠার বছর বয়স খুব দুঃসহ, কামালের হার্টবিট মিস হয়। এটাকে কী লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে?
নীরা কোন সাধারণ মেয়ে ছিল না। শী ওয়াজ ডিফারেন্ট। বাহিরে মিষ্টি শান্ত চেহারার মেয়েটা মনের ভেতর ভীষণ বাউন্ডুলে আর পাগল। রাত তিনটার সময় সে লাউড স্পীকারে শোনে জেমস কিংবা আনুশেহ আনাদিল -
ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা / পান খাইয়া যাও / বাঁশী আল্লাহ'র দোহাই
এই পরানের বিনিময় / তোমার পরান দিও / বাঁশী আল্লাহ'র দোহাই
ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা / পান খাইয়া যাও / বাঁশী আল্লাহ'র দোহাই।
নীরারা তিন বোন – মীরা, নীরা, সারা। নীরা মেজ, তিন বোনই সমান ডানপিটে। কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় দুষ্টামি গুলো একসাথে করে। হঠাত রাতে তিনজন মিলে রিকশায় করে ফুচকা খেতে যায়, বোকাসোকা কোন ছেলে রাস্তায় দেখলে পঁচানি দেয়, হাতে মেহেদী দিয়ে রাতভর গানের কলি খেলে – আনন্দময় জীবন। শুধু মায়ের একাকীত্ব দেখলে কষ্ট লাগে, বাবা তখন আটলান্টিক কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ছুটে চলা জাহাজের ডেকে কাজে ব্যস্ত। নীরা মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে প্রেম-বিয়ে যাকে করবে তাকে একটা দিন চোখের আড়াল করবে না, তার প্রতিটা কাজে সাথে সাথে থাকবে।
কামাল সেই যে নীরার প্রেমে পড়েছে আর উঠতে পারে নাই। তার কাছে মনে হয় নীরা সবসময় সাথে আছে। কয়েক মাস হল কামালের নিজের একটা কম্পিউটার হয়েছে। বাসায় ফিরে ড্রেস ছাড়ার আগে গান ছাড়ে। আদনান সামির ‘কাভি তু নাজার মিলাও’ / ‘তেরা চেহরা’, আলিশার ‘দিলবার জানিয়া’। মাঝে মধ্যে বাথরুমের কল ছেড়ে হেরে গলায় গান ধরে পথিক নবী –
আমার একটা নদী ছিল / জানলো নাতো কেউ
এইখানে এক নদী ছিল / জানলো নাতো কেউ
নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না / ছিল শুধু ঢেউ
আমার একটা...
কামাল একেবারে মধ্যবিত্তের ছেলে, দেখতে-শুনতে বিলো এভারেজ। নীরাকে প্রপোস করার মতন দুঃসাহস কোনদিন হবে না। শুধু একটাই চিন্তা কোনভাবে বুয়েটে চান্স পেলে নিজের একটা পরিচয় হবে, তারপর প্রপোস করবে। খিলগাঁও রেলগেটের ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে ভবিষ্যতের ক্যানভাস সাজায়। পাঁচ বছরে অনার্স শেষ করতে পারলে তেইশ বছরে চাকরী, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দুই বছরের মধ্যে বেতন চল্লিশ হলে বিয়ে করবে, নীরা অবশ্যই এই অল্পসময় অপেক্ষা করবে।
দুর্বোধ্য হাজারী-নাগের রসায়ন, সুশান্তের পদার্থবিজ্ঞান অসহ্য লাগে, শুধু ভাল লাগে আফসার উজ-জামানের জ্যামিতি ও ক্যালকুলাস। আরো ভাল লাগে ক্লাস বাং মেরে লাইব্রেরীতে বসে শরৎচন্দ্র সমগ্র পড়তে, বন্ধু রানার কাছ থেকে ধার করে আনা সমরেশ মজুমদারের পাঁচটি উপন্যাস – আট কুঠুরি নয় দরজা / গর্ভধারিনী। দাঁতে দাঁত চেপে স্বপ্নের বুয়েট, আইডল রুমন ভাই, নীরার ভালবাসা ভেবে পড়াশুনা চালিয়ে যায়, একেকটা এগজ্যাম শেষ হলে শানের ‘ভুল যা’ গান রিপিট দিয়ে কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ইদানীং নীরা কেমন যেন বিমর্ষ চুপচাপ হয়ে গেছে কামালের মনে হয়। মামুন স্যারের ব্যাচের পোলাপান ঠিক করে একসাথে সবাই মুভি দেখতে যাবে – হুমায়ুন আহমেদের চন্দ্রকথা, নতুন আসছে। নীরা প্রথমে আগ্রহ দেখায়, নীরার পাশে বসে মুভি দেখবে কল্পনায় কামাল রোমাঞ্চিত। টিকেট কাটার আগ দিয়ে নীরা না করে দেয়, হতাশ কামাল টিকেট কাটতে গিয়ে দেখে মধুমিতায় চন্দ্রকথা চলছে না, নতুন মুভি আসছে ‘মনের মাঝে তুমি’। নটরডেমের ছেলেরা গ্রুপ ধরে ক্লাস বাং মেরে বাংলা সিনেমা দেখতে যায়, রিয়াজ-পূর্ণিমা বাম্পার হিট। সিনেমা দেখে কামালের আরো বেশী প্রেম প্রেম ফীলিংস আসে, লম্বা ডায়েরী লিখতে বসে যায় - আচ্ছা নীরার কী হয়েছে? নীরা এখন কী ভাবছে?
সেবছর ভ্যালেন্টাইনস ডের দিন হরতাল। ঐদিন মামুন স্যারের ব্যাচের পড়ার ডেট। কামাল একদিকে মহাখুশী ভ্যালেন্টাইনস ডে তে ভালবাসার মানুষ কে দেখতে পাবে, আরেকদিকে শঙ্কা হরতালের দিনে সে কি আসবে? যদি আসে লাল ড্রেস পরে আসবে? দিবাস্বপ্নে ‘সিলসিলা ইয়ে চাহাত কা’ গানে ঐশ্বরিয়ার জায়গায় লাল শাড়ীতে নীরা কে কল্পনা করে।
নীরা আসে, বিমর্ষ আত্মমগ্ন, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কালো একটা ড্রেস পরে আসে, কেউ একজন জিজ্ঞাসা করে – নীরা ব্ল্যাক কেন আজকে?
আজকে আমার শোকের দিন তাই – নীরার ঠাণ্ডা উত্তর।
কামাল ভাবে নীরা কি কারো প্রেমে পড়ে ব্যর্থ হয়েছে? নীরার মত এত উচ্ছ্বল দুর্দান্ত মেয়ে কে রিজেক্ট কিভাবে কেউ করতে পারে!
হঠাত নীরা বলে – কামাল, তোমার কাছে রাবার আছে?
অনেক খুঁজেও কামাল ব্যাগে কোন রাবার খুঁজে পায় না, হতাশা – একটা দিন নীরা কিছু চাইল, কামাল দিতে পারল না। নীরা আবার তার আপন জগতে হারিয়ে যায়।
কথায় কথায় একদিন কামাল জানতে পারে নীরা আর তার কিছু বান্ধবী রুমন ভাইয়ের কাছে ব্যাচে ফিজিক্স পড়ে। রুমন ভাইয়ের গল্প করার সময় নীরার চোখে একটা অদ্ভুত আলো দেখা যায় – ভাইয়া এমন দুর্দান্ত ভাবে বোঝায় না? আমার সারাদিন ফিজিক্স পড়তে ইচ্ছা করে, আর কোন সাবজেক্ট না। কামাল, তোমরাও একটা ব্যাচ করে রুমন ভাইয়ের কাছে যেতে পারো, সে অসাধারণ পড়ায়।
কামাল ভাল করে জানে, রুমন ভাই দারুণ পড়ায়। তার নিজের ফিজিক্স কোর্স প্রায় শেষের পথে, আরেকটা নতুন ব্যাচে পড়ার সামর্থ্য বা প্রয়োজন কোনটাই নাই। নীরা কি রুমন ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে? পড়লেই বা কী আসে যায়! রুমন ভাই বস মানুষ, কতজনের ক্রাশ।
নীরার আসলে পড়াশোনায় কোন মন নাই। পরীক্ষা আগায় আসতেছে, তার খবর নাই, ব্যাচে অনিয়মিত, মডেল টেস্ট দেয় না। রোজার মাস শুরু হল। নীরা ঠিক করেছে তিনবার কোরান শরীফ খতম দিবে। রোজায় তিন খতম দিয়ে কেউ যদি খাস দিলে আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ অবশ্যই সেই আশা পূরণ করবেন।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়, কামাল নব্বই ভাই সন্তুষ্ট, পরীক্ষা ঠিকঠাক হয়েছে, আশা করা যায় বুয়েটের ফর্ম তুলতে কোন অসুবিধা হবে না। খুশী মনে একদিন মামুন স্যারের সাথে দেখা করতে যায়।
স্যার, দ্বিতীয় পত্র খুব ভাল হয়েছে, কোন মার্কস ছাড়ি নাই। প্রথম পত্র সময় কম হয়ে গেছে, আট মার্কস শেষ করতে পারি নাই।
কী বলো কামাল? সিনথিয়া বলল, পনের মিনিট আগে শেষ করে রিভাইস দিছে।
স্যার, ও তো ঐরকমই। বাদ দেন। বাকীদের কেমন হয়েছে কিছু বলছে – রাকিব, জনি, নীরা?
সবার ভাল হয়েছে। নীরার কথা জিজ্ঞেস করো না। অপদার্থ একটা।
কেন স্যার, কী হইছে? নীরার মনে হয় প্রিপারেশন ভাল ছিল না।
আরে না, সে পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। বিয়ে করেছে।
কামাল মনে হয় জীবনে এমন অদ্ভুত কথা শোনে নাই, কল্পনার বাইরে। এটা স্যার কী বলল?
হ্যাঁ নীরা আসছিল একদিন। বলল সে বিয়ে করেছে। পাত্র তোমরা চিনবা, তোমাদের কোচিং এর স্যার রুমন। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, এমন বোকার মত কাজ এই সময়ে কেন করল মাথায় আসছে না।
এবারের শক কামালের গায়ে অতটা লাগে নাই। তার প্রথম প্রেম নীরা বিয়ে করে ফেলছে, যোগ্য একজনকে বিয়ে করেছে, নীরার জন্য এই শহরে রুমন ভাইয়ের থেকে পারফেক্ট কেউ ছিল না।
তারপর? – তমাল কে অনেকক্ষণ চুপ দেখে রিমি জিজ্ঞেস করে।
তারপর আর কী! গল্প শেষ। কামাল মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে, ক্রাশ বিয়ে করছে শুনে সে দেবদাস হয় নাই, ভাল ভাবে পরীক্ষা দিয়ে বুয়েটে চান্স পেয়েছে।
সাবজেক্ট চয়েস দেয়ার আগে তমাল রুমন ভাই কে ফোন দিল, ভাইয়া আমি অমুক, আপনার ক্লাস করেছি অনেক। বুয়েটে চান্স পাইছি, একটা পরামর্শ দরকার।
আচ্ছা খুব ভাল কথা। বলো কি পরামর্শ?
ভাইয়া আমার পজিশন মোটামোটি, ইইই পাবো না মনে হয়, ফার্স্ট চয়েজ কী দিবো বলেন – সিএসই, ইইই নাকি অন্যকিছু। সিএসই এর ডিমান্ড নাকি পড়ে যাচ্ছে, চাকরীর ফিউচার কেমন?
হুমম, চাকরী নিয়া এখন ভাবার সময় হয় নাই, তোমার যেটা প্যাশন সেটার চয়েজ দাও। চান্স পাবার আগে সিএসই আমারো ড্রিম ছিল, পরে ভাল লাগে নাই। অনেক সময় দিতে হয় ক্লাসের বাইরে নিজে নিজে। কি বলব, আগে যদি এটার প্যারা জানতাম আমি হয়ত অন্য সাবজেক্টে পড়তাম, হয়ত বুয়েটে পড়তাম না, আইবিএ ভর্তি হতাম।
রুমন ভাইয়ের সাথে কথা বলে কামাল বিভ্রান্ত হয় না। সে চোখ বন্ধ করে সিএসই সিলেক্ট করে, আর কোন চয়েজ তার পক্ষে দেয়া সম্ভব না, ড্রিম কামস ফার্স্ট।
বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। গল্প শেষ, রিমি আর তমাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
রিমি – ইন্টারেস্টিং একটা সময় কাটল আপনার সাথে গল্প করে। আজ যাই।
তমাল – হ্যাঁ ভাল লাগল। অন্য আরেকদিন আবার নতুন গল্প করা যাবে, কি বলেন?
রিমি হাসে, রহস্যময় হাসি।
[সম্পূর্ণ ফিকশন, কারো সাথে মিলে গেলে লেখকের কিছু করার নাই]
© হাসিব জামান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন